কোরবানির পশু জবাইয়ের ছবি-ভিডিও ফেসবুকে কেন!
মেহেদী হাসান নাঈম
মুসলিম উম্মাহর সবচেয়ে বড় দু’টি ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে একটি ঈদ-উল আযহা। বাঙালি সমাজে কোরবানির ঈদ নামেও পরিচিত অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব এটি। ত্যাগ আর উৎসর্গের আদর্শে মহিমান্বিত পবিত্র এই দিন। মহান আল্লাহর অপার অনুগ্রহ লাভের আশায় ঈদুল আজহার নামাজ শেষে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা সামর্থ্য অনুযায়ী পশু কোরবানি করেন। এই ঈদে সমাজের ধনী-গরিব সকলের মধ্য আন্তরিকতা আর ধর্মীয় সম্প্রীতির চমৎকার বন্ধন উপলব্ধি করা যায়।
তবে বর্তমান সময়ে কোরবানি ঈদে অনেকের মধ্যেই অতি উৎসাহ লক্ষ্য করা যায়। ফলে তারা নিজেদের কোরবানির পশুর ছবি তুলে ফেইসবুক সহ বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করেন। সাথে আবার খুব আহ্লাদ করে লক্ষাধিক অঙ্কের দামটিও লিখে দেন। সেই পোস্টের মন্তব্যের ঘরে অনেকে আবার বলেন, “ভাই জিতছেন”। এখানেই অতি উৎসাহের শেষ নয়। ত্যাগের মহিমায় মহিমান্বিত হয়ে আমরা অনেকে আবার পশু জবাইয়ের মুহূর্তে ছবি তুলি, করি ভিডিও ধারণ। সাথে সাথে সেই ছবি আর ভিডিও আপলোড হয় সোস্যাল মিডিয়ায় নিজেদের বিভিন্ন ওয়ালে। এভাবেই চলে আমাদের কোরবানি ঈদ।
কিন্তু আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি, আমারা যা করছি তা আসলেই ঠিক কিনা? আমাদের বিবেক কি বলে? ঈদে পরিবার পরিজনের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে আনন্দঘন ছবির পাশাপাশি ঘুরে বেরানো কোরবানির পশু জবাই ও কাটার ছবি কিংবা ভিডিও শুধু মাত্র রক্তাক্ত পশুর প্রতিচ্ছবি নয়। বরং এটি আমাদের অসুস্থ মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। আমাদের সমাজে অনেকেই আছেন যাদের কোরবানী করার সামর্থ নেই। কখনো কি ভেবে দেখেছি আমাদের এসব ছবি বা ভিডিও চোখে পারার পর তাদের কষ্ট হয় কিনা? কোরবানি করতে না পারার আক্ষেপ কিংবা কষ্ট আমারা বাড়িয়ে দিচ্ছি না তো?
শোলাকিয়া ঈদগাহের খতিব ফরীদ উদ্দীন মাসঊদের মতে, মৌলিক ভাবে ধর্মের বিধান পালন মানেই হচ্ছে তাকওয়ার সাধনায় উত্তীর্ণ হয়ে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন। ফেসবুকে ছবি প্রকাশ বা অন্য যে কোনো ভাবেই হোক নিজের কৃতিত্ব জাহির মৌলিকভাবে ধর্মীয় চেতনা বহির্ভূত। কোরবানি একটি ইবাদত। এই ইবাদত আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য নিজের বাহাদুরি প্রকাশ, ফূর্তি বা বিকৃত মনোভাব প্রকাশ ইসলামি চেতনাবিরোধী বিষয়। কোরবানির পশু জবাই কিংবা কোরবানি পশু নিয়ে ফেসবুকে বা অন্য কোনো ভাবে বাহাদুরি, অহেতুক ফূর্তি পরিহার করা উচিত।”
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা মাহফুজুল হকের মতে, “কোরবানির পশুর বিকৃত ছবি হোক আর স্বাভাবিক ছবি হোক, ফেসবুকে বা অন্য কোনো মাধ্যমে অপ্রয়োজনে প্রকাশ শরিয়তের দৃষ্টিতে পছন্দনীয় কাজ নয়।” পবিত্র কোরআন শরীফে আল্লাহ বলেছে, “আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না এর গোশত ও রক্ত, পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া।” (সূরা: মায়িদা, আয়াত: ২৭) ইসলাম ধর্মীয় বিশ্বাস যেখানে বলে কোরবানির ঈদ আত্মত্যাগের শিক্ষা দেয়। সেখানে প্রদর্শনবাদিতা কিংবা বীভৎসতা প্রদর্শন ঠিক কতটা যৌক্তিক, সেটি এখন বড় প্রশ্ন।
আমাদের এমন কর্মকান্ডের কারণ কি? আমার কি লোক দেখানো কিংবা অন্যের বাহবা পাওয়ার জন্য ছবি বা ভিডিও প্রকাশ করি? নাকি নিজের কোরবানীর পশু কত বড়, কত দামে কিনেছি কিংবা মাংস কত কেজি হয়েছে, এসব বিষয় সকলকে দেখাতে চাই? যদি তাই হয় তাহলে সেটি খুবই হতাশার। পবিত্র কোরআনের লোক-দেখানো ইবাদতকারীদের ব্যাপারে বলা হয়েছে, “ধ্বংস সেসব নামাজির জন্য, যারা তাদের নামাজের ব্যাপারে উদাসীন, যারা লোক দেখানোর জন্য তা করে।” (সুরা মাউন: ৪-৭)
বস্তুত সেলফি তোলা, ভিডিও করা, কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করা ইত্যাদির মাধ্যমে ইবাদতের মূল উদ্দেশ্যটাই যখন ক্ষুণ্ণ হয়ে যায়, তখন বাকি পরে থাকে শুধু রক্ত-মাংস আর ভোগ বিলাস। আমাদের বুঝতে হবে, বেশি দামি গরু কিনে জবাই দেওয়ার মাধ্যমে মানুষের কাছে নিজেকে জাহির কার মানে কোরবানী নয়। প্রকৃতপক্ষে কোরবানিদাতা কেবল পশুর গলায় ছুরি চালায় না বরং সে তো ছুরি চালায় সকল প্রবৃত্তির গলায়। এর মধ্য দিয়ে অদৃশ্য মনের পশুও কোরবানি হয়। পরিস্কার হয় আমাদের হৃদয়, শুদ্ধ হয় তাকওয়া। আর এটিই কোরবানির মূল নিয়ামক। এই অনুভূতি ব্যতিরেকে কোরবানি করা হযরত ইবরাহিম ও হযরত ইসমাইল (আ.)-এর সুন্নত পালন নয়, বরং একটি প্রচলিত প্রথা মেনে চলা মাত্র। যেখানে গোশতের ছড়াছড়ি হয় বটে কিন্তু ঐ তাকওয়া হাসিল হয় না, যে তাকওয়া কোরবানির প্রাণশক্তি।
বনের পশু নয়, এটি মনের পশু কোরবানীর দিন। আধুনিকতা আর স্মার্টনেসের নামে আমরা নিজের অজান্তেই আমাদের বিবেক বোধ হারিয়ে ফেলেছি। ফলে আজ প্রশ্নবিদ্ধ আমাদের মানসিকতা। অসুস্থ আমাদের বিবেক। হযরত ইবরাহিম (আ.) ও হযরত ইসমাইল (আ.)-এর অতুলনীয় নিষ্ঠা ও অপূর্ব ত্যাগের পুণ্যময় এই কোরবানী যেন আমাদের কাজে ফলে প্রশ্নের মুখে না পরে, সেটিও দেখার দায়িত্ব আমাদের সকলের।