২০১৮ সালে বাতিল হয়েছিল ১. ১৮% আর ২০২৪ সালে বাতিল হয় ২.৯০ শতাংশ

বগুড়ায় কম উপস্থিতিতেও ভোট বাতিলের হার বেশিঃ ইচ্ছাকৃত নাকি অজ্ঞতাবশত? 

বিশেষ প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১১ জানুয়ারী ২০২৪ ১৭:০৭ ।
দেশের খবর
পঠিত হয়েছে ৩৩ বার।

একাদশ সংসদ নির্বাচনের তুলনায় সদ্য অনুষ্ঠিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে বগুড়ায় ভোটার উপস্থিতি ৪৬ শতাংশ কম হলেও ভোট বাতিলের হার প্রায় আড়াইগুণ বেড়েছে। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে প্রদত্ত মোট ভোটের মধ্যে বাতিল হয় ১ দশমিক ১৮ শতাংশ ভোট। আর গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের মধ্যে ২ দশমিক ৯০ শতাংশ বাতিল হয়ে যায়।

 


ওই দু’টি নির্বাচনে বগুড়ায় ভোট কেন্দ্রগুলোতে নির্বাচনি দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তা এবং প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থীদের এজেন্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৮ সালে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভোট বাতিল হয়েছিল দু’টি প্রতীকের মাঝামাঝি সিল মারা এবং ভুলভাবে ব্যালট ভাঁজ করায় এক প্রতীকের সিল অন্য প্রতীকে লেগে যাওয়ার কারণে। তবে ২০২৪ সালে ভোট বাতিল হয়েছে ব্যালটে একটি নির্দিষ্ট প্রতীকের বাইরে একাধিক প্রতীকে সিল মারার কারণে। পাশাপাশি ফাঁকা ব্যালট অর্থাৎ কোন প্রতীকে সিল না দিয়েই বাক্সে ফেলা হয় এমন ব্যালটও মিলেছে প্রচুর।

 


ভোটার উপস্থিতি কম হলেও এবার ভোট বাতিলের হার বেশি এবং ব্যালটে একাধিক প্রতীকে সিল মারা ও ফাঁকা ব্যালট বাক্সে ফেলার এই প্রবণতাকে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা ভোটারদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তারা বলছেন, বিএনপি’র বর্জনের কারণে কেন্দ্রগুলোতে উপস্থিতি বাড়ানোর জন্য অনেক ক্ষেত্রেই ভোটারদের চাপ কিংবা প্রচ্ছন্ন হুমকি দেওয়া হয়েছে। যাদেরকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভোট কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে তাদের একটি অংশ প্রতিবাদ হিসেবে এমনভাবে ভোট দিয়েছে যাতে তা বাতিল হয়ে যায়।

 


নির্বাচন কার্যালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বগুড়ায় বর্তমানে ২৮ লাখ ৩০ হাজার ৬০৪জন ভোটারের মধ্যে গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ৭টি আসনে মাত্র ৮ লাখ ৪৩ হাজার ৫৬৩জন ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। ভোট প্রদানের হার ছিল ২৯ দশমিক ৮০ শতাংশ। অবশ্য প্রদত্ত ভোটের মধ্যে নানা কারণে ২৪ হাজার ৫০৬টি ভোট বাতিল করা হয়। বাতিলের হার ২ দশমিক ৯০ শতাংশ। নির্বাচনে ৭টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ এবং ১৪ দলীয় জোট মনোনীত ৫জন প্রার্থী বিজয়ী হন। বাকি দু’টি আসনের একটিতে এক আওয়ামী লীগ নেতা এবং অপর একটি আসনে আওয়ামী লীগের মিত্র দল জাতীয় পার্টির মনোনীত প্রার্থী বিজয়ী হন। 

 


অন্যদিকে পাঁচ বছর আগে ২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনে মোট ভোটার ছিলেন ২৫ লাখ ৪২ হাজার ৪৫৮জন। অবশ্য ওই নির্বাচনে মোট ১৯ লাখ ৩২ হাজার ৪৩৩জন ভোট দিয়েছিলেন। ভোট প্রদানের হার ছিল ৭৬ শতাংশ। যা এবারের চেয়ে ৪৬ দশমিক ২ শতাংশ বেশি। ওই নির্বাচনে জেলার ৭টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি ২টি করে আসনে জয় পায়। অপর আসনে বিএনপি সমর্থিত অপর এক স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয়ী হয়েছিলেন। ধারণা করা হয়, আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিসহ নিবন্ধিত সিংহভাগ রাজনৈতিক দলের অংশ গ্রহণের কারণে ২০১৮ সালের নির্বাচনে ভোটের হার বেশি ছিল। পক্ষান্তরে বিএনপি’র মত বড় দল বর্জন করায় সদ্য অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ভোট প্রদানের হার কমে যায়। 

 


নির্বাচন কার্যালয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এবার আসনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৪ দশমিক ৯২ শতাংশ ভোট বাতিল হয়েছে বগুড়া-৩ (আদমদীঘি ও দুপচাঁচিয় উপজেলা) আসনে। আর ২০১৮ সালে এই আসনে বাতিল হয়েছিল ১ দশমিক ২২ শতাংশ ভোট। এবার বগুড়া-৭ (গাবতলী ও শাজাহানপুর উপজেলা) আসনে বাতিল হয় ৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ ভোট। ২০১৮ সালে ওই আসনে বাতিল হয় ১ দশমিক ৬২ শতাংশ ভোট। সদ্য অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বগুড়া-২ (শিবগঞ্জ উপজেলা) আসনে বাতিল হয় ২ দশমিক ৯৩ শতাংশ ভোট। পাঁচ বছর আগে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বাতিল হয়েছিল ১ দশমিক ১৯ শতাংশ ভোট। এবার বগুড়া-৪ (কাহালু ও নন্দীগ্রাম উপজেলা) আসনে বাতিল হয় ২ দশমিক ৯৫ শতাংশ ভোট আর ২০১৮ সালে বাতিল হয়েছিল ১ দশমিক ৩৭ শতাংশ ভোট। বগুড়া-৬ (সদর উপজেলা) আসনে এবার বাতিল হয় ২ দশমিক ৬৭ শতাংশ ভোট বাতিল হলেও ২০১৮ সালে বাতিল হয় শূন্য দশমিক ৯৭ শতাংশ ভোট। বগুড়া-৫ (ধুনট ও শেরপুর উপজেলা) আসনে এবারের নির্বাচনে ২ দশমিক ২০ শতাংশ ভোট বাতিল হয়। ২০১৮ সালে বাতিল হয়েছিল ১ দশমিক ১৩ শতাংশ ভোট। অন্যদিকে বগুড়া-১ (সোনাতলা ও সারিয়াকান্দি উপজেলা) আসনে ২০২৪ সালে বাতিল হয় ১ দশমিক ২৫ শতাংশ তবে ২০১৮ সালে আসনটিতে শূন্য দশমিক ৭৭ শতাংশ ভোট বাতিল করা হয়েছিল।

 


বগুড়া শহরের পিটিআই স্কুল কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর এজেন্ট ফারুক হোসেন বাবু জানান, তিনি এবার এবং ২০১৮ সালেও ওই কেন্দ্রে নৌকা প্রতীকের এজেন্টের দায়িত্ব পালন করেছেন। এবার ওই কেন্দ্রের পুরুষ কেন্দ্রের ৬টি বুথে মোট ২৪টি ব্যালট বাতিল হয়ে গেছে। অথচ ২০১৮ সালে ওই কেন্দ্রে ১০ থেকে ১২টি ব্যালট বাতিল হয়েছিল। ফারুক হোসেন বাবু বলেন, এবার পিটিাআই কেন্দ্রে যে ২৪টি ব্যালট বাতিল করা হয়েছে তার মধ্যে ৩টি ছিল ফাঁকা। আর ৩টিতে নৌকাসহ ৩টি প্রতীকে সিল মারা ছিল। বাকি ১৮টির মধ্যে একটি ব্যালটের প্রতীকগুলোর বাইরে একেবারে উঁচুতে সিল মারা হয়। আর অন্য ১৭টি ব্যালটে দু’টি করে প্রতীকে সিল মারা হয়। ভোটাররা ক্ষুব্ধ হয়েই কি এ ধরনের কাজ করেছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা তো বলা মুশকিল’।

 


খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বগুড়ার গাবতলী উপজেলার রাণীরপাড়া বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এবার ৬৯টি ভোট বাতিল হয়ে গেছে। ওই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তার দায়িত্বপালনকারী লোকমান হাকিম জানান, একাধিক প্রতীকে সিল দেওয়ার কারণেই বেশিরভাগ ভোট বাতিল করতে হয়েছে। তার ধারণা মহিলা ভোটাররা হয়তো অজ্ঞতাবশত একাধিক প্রতীকে ভোট দিয়েছেন। বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজ কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তার দায়িত্বপালনকারী ফখরুল মুলখ জানান, তার কেন্দ্রে যে ৭টি ব্যালট বাতিল হয়েছে তার মধ্যে ৩টি ছিল ফাঁকা আর ৩টিতে একাধিক প্রতীকে সিল দেওয়া ছিল। বাকি একটি নির্দিষ্ট একটি প্রতীকে সিল মারার পর তার ওপরে এবং নিচের অন্য প্রতীকের চিহ্নগুলো ছিঁড়ে বাক্সে ফেলা হয়। বগুড়া সদরের একটি ভোট কেন্দ্রে সহকারি প্রিসাইর্ডি কর্মকর্তার দায়িত্ব পালনকারী অপর এক স্কুল শিক্ষক প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ২০১৮ সালের তুলনায় এবার ভোট বাতিলের সংখ্যা কিছুটা বেশি ছিল।

 


বগুড়া সদরে একটি ভোট কেন্দ্রে সহকারি প্রিসাইডিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালনকারী একজন জানিয়েছেন, ২০১৮ সালের তুলনায় এবার বাতিল ব্যালটের সংখ্যা বেশি। তিনি জানান, ২০১৮ সালে অল্প যে কয়েকটি বাতিল হয়েছিল সেটি দু’টি প্রতীকের মাঝামাঝি সিল মারার কারণে। কিন্তু এবার একাধিক প্রতীকে ভোট দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলার একটি ভোট কেন্দ্রে সহকারি প্রিসাইর্ডিং কর্মকর্তার দায়িত্বপালনকারী এক স্কুল শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, আগের নির্বাচনগুলোতে প্রতীকগুলো খুব কাছাকাছি ছিল। যে কারণে অনেকের সিল দু’টি প্রতীকের মাঝামাঝি পড়ে যেতো। কিন্তু এবার ব্যালটে প্রত্যেকটি প্রতীকের চারপশে বেশ ফাঁকা জায়গা রাখা হয়েছিল। সে কারণে দু’টি প্রতীকের মাঝে সিল পড়ার কোন সুযোগ ছিল না। ফলে যারা একাধিক প্রতীকে সিল মেরেছেন তারা তা পরিকল্পিতভাবেই মেরেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা শুনেছি অনেক ভোটারকে ভোট প্রদানের জন্য চাপ দেওয়া হয়েছিল। এতে অনেকে ক্ষুব্ধ ছিলেন। যে কারণে তাদের অনেকে ভোট কেন্দ্রে এলেও হয় একাধিক প্রতীকে সিল মেরেছেন নয়তো ব্যালট ফাঁকা রেখেছেন।’

 


সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযানের (সুপ্র) বগুড়া জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক কেজিএম ফারুক জানান, একটি ব্যালটে একাধিক প্রতীকে সিল মারা কিংবা ব্যালট ফাঁকা রাখার বিষয়টি খুবই পরিকল্পিত। যাদেরকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভোট দিতে বাধ্য করা হয়েছে তারাই এ ধরনের কাজ করতে পারে। তিনি ভবিষ্যতে এ ধরনের কর্মকাণ্ড রুখতে ভোট প্রদানে চাপ সৃষ্টি বন্ধ করার পাশাপাশি ভোট প্রদানের ব্যবস্থাকে স্মার্ট করার দাবি জানিয়ে বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের জন্য রাষ্ট্রের অনেক অর্থ ব্যয় হয়। তো সেই অর্থ যাতে অপচয় না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এজন্য ভোট ব্যবস্থাকে স্মার্ট করতে হবে।’