ছোটগল্পঃ লেখক

অসীম কুমার কৌশিক
প্রকাশ: ০১ মার্চ ২০২৪ ২০:৩৫ ।
শিল্প ও সাহিত্য
পঠিত হয়েছে ১৪ বার।

অদিমের ঘরের দেয়াল জুড়ে গল্পের ভীড়। লিফলেটের মতো দেয়ালে সাটানো সব গল্প। যেন গল্পদের সাথে কত কথা। রাত কেটে যায় গল্পদের সাথে কথা ফুরোয় না তবুও। রোজ একটি করে নতুন গল্প যুক্ত হয় দেয়ালে। এটা তার পুরোনো অভ্যেস। তবে সেটা আরো তীব্র এখন।

অদিম এই শহরের অপ্রকাশিত গল্প সৃষ্টির এক অদ্ভূত কারিগর।

এই কংক্রিটের শহরে রোজ কতো মানুষ নিখোঁজ হয়, প্রেম খোঁজে। দিনের মতোই যেন রাস্তা গুলোর ব্যস্ততা ফুরোতেই চায় না। রাস্তায় হাঁটছে আর ভাবছে অদিম। মাথাভর্তি চুল। গায়ে শালের চাদর জড়ানো।

মোহাম্মদপুর এলাকায় একটি বাসায় থাকে সে এখন। বাসার বাইরে বের হলে গায়ে এভাবেই চাদর জড়িয়ে থাকে অদিম। যেন কেউ চিনতে না পারে। কোনো অপরাধী নয়, অদিম এখন অনেক বড় একজন লেখক।

ফুটপাতের চায়ের দোকান থেকে এক কাপ চা নিয়ে ওভারব্রীজের উপর চলে যায় অদিম। এটা যেন তার নিত্যদিনের অভ্যেস হয়ে গেছে। উপর থেকে নীচের রাস্তা গুলোতে যানবাহনের রঙিন আলোর খেলা সে খুব উপভোগ করে। তবে আজ একটু অন্যরকম। কেমন যেন স্তব্ধতা। রুহানকে ফোন দিয়ে আসতে বলে অদিম। প্রতিদিনের মতোই আকাশের দিকে মুখ করে চোখ বন্ধ করে কোথায় যেন হারিয়ে গেলো সে।

গায়ে প্রচণ্ড জ্বরের তীব্রতা। রাত তখন ২ টা বাজতে চলেছে। আল্পনার ফোন পেয়ে দেয়াল থেকে চোখ সরিয়ে নেয় অদিম।
কি করছে আমার গল্পের জাদুকর?
এইতো দেয়ালের নতুন গল্পের সাথে কথা বলছি।
অদিম, আমি চাই তুমি অনেক বড় লেখক হও। আমার চাওয়াটা পুরণ করো হ্যাঁ।
ঠিক আছে। খেয়েছো?
হ্যাঁ। তুমি?
দার্শনিকদের নাকি ক্ষুধা থাকতে নেই। আমি তো দার্শনিক নই তাই গল্প ভক্ষণ করি।
রাগ করে ওপাশ থেকে ফোন কেটে দিলো আল্পনা।

মাথার পাশে ফোন রেখে জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো অদিম। আল্পনার কথা ভাবাচ্ছে আজ তাকে। লেখক হতে হবে।

প্রকৃতিতে তখন ঋতুরাজের আগমনের জোয়ার। কিন্তু অদিমের মন গ্রীষ্মের মতোই রুক্ষ। শীতের মতোই বেজায় শুষ্ক । আর কত গল্প ভক্ষণ করতে হবে কে জানে!

সকাল পেরিয়ে দুপুর হতে চলেছে। অদিমের সাথে দেখা করতে এসেছে আল্পনা। সারারাত ঘুমাতে পারেনি অদিমের সাথে রাগ করে। কিন্তু এসে দেখে অদিমের ঘরে তালা। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে মেয়েটির। সারাদিন খোঁজাখুঁজির পরও দেখা মেলেনি অদিমের। ক্লান্ত শরীরে বাসায় ফিরে যায় সে।

দুইদিন হয়ে গেলো ফোন বন্ধ অদিমের। বাড়িতেও যায় নি খোঁজ নিয়েছে আল্পনা। এভাবেই কেটে যায় দিন। আল্পনা অপেক্ষা করে থাকে অদিম আসবে একদিন। ঠিকই আসবে।

সপ্তাহ দু’য়েক হলো নতুন শহর ঢাকায় এসেছে অদিম, কাউকে কিছু না জানিয়ে। এদিকে বাড়িতে না জানিয়ে আসার জন্য অদিমের বাবা-মা ব্যকুল। স্থানীয় থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছে অদিমের বাবা। রোজ থানায় যায় ছেলের কোন খোঁজ এসেছে কিনা জানতে।

আল্পনার ইচ্ছে পূরণের জন্য অদিম তার শহর, আপনজন সব ছেড়েছে। তাকে যে বড় লেখক হতে হবে। ছোট্ট একটি ঘরে চলে অদিমের লেখা। আল্পনার দেওয়া সোনার চেন বিক্রি করেছে অদিম। দুই মাস থাকার জন্য জরাজীর্ণ এই ঘরটি ভাড়া নিয়েছে সে।

বেশির ভাগ সময় লেখায় বুদ হয়ে থাকে অদিম। যেন মহাকাশের পৃথিবী নামক গ্রহ একান্তই সে একা। কোথাও কেউ নেই। মাঝে মাঝে তার এক বন্ধু রুহান আসে। কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে চলে যায়।

প্রায় দেড় মাস হতে চললো অদিম এখনো নিখোঁজ সকলের কাছে।

উপন্যাসের শেষ পাতা বাঁকি। আজ রাতেই উপন্যাসটি লিখা শেষ করবে অদিম। তারপর সেটি বন্ধু রুহানের মাধ্যমে প্রকাশনীতে দিবে। রুহানের বাবা ঢাকার বিখ্যাত প্রকাশনীর মালিক। কাকতালীয় ভাবেই রুহানের সাথে পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব হয় অদিমের।

সবকিছুই জানে রুহান। সেও অনেক খুশী। অদিমের উপন্যাস শেষ হতে চলেছে।

এদিকে রাতে উপন্যাসের শেষ পাতা লিখতে বসে অদিম। পুরো উপন্যাস জুরে যে অপ্রাপ্তি ছিলো শেষ পাতায় সেটির পরিপূর্ণতা দিয়ে লিখাটা শেষ করে সে।

সকালে বন্ধু রুহান আসে। আজ অনেক খুশী তারা দু’জনেই। এবার বইমেলায় প্রকাশিত হবে অদিমের প্রথম উপন্যাস।

বাইরে ফুতপাতের দোকানে চা খেতে-খেতে পত্রিকা পড়ছে রুহান। হঠাৎ একটি হেডলাইনে চোখ আটকে যায় তার। অদিম, এই অদিম। দেখ কি হৃদয় বিদারক ঘটনা বলে অদিমের দিকে পত্রিকা এগিয়ে দেয় রুহান। ‘ছেলেকে খুঁজতে বের হয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় স্বামী-স্ত্রীর মৃত্যু’ হেডলাইনটির নীচে ছবি দেখে আর পড়ার সাহস হয় নি অদিমের।

'কিরে কি হলো তোর। কথা বলছিস না যে। অদিম কি হলো।'

দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ঝড়ছে অদিমের। রুহানকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে সে। লেখক হতে গিয়ে আমি আমার বাবা-মা এর মৃত্যুর কারণ হলাম রুহান।
কি বলছিস এসব বলে অদিমের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে রোহান।

এরপর অদিম সবকিছু বলে রুহানকে।

দৌড়ে রুমের দিকে যায় দু’জন। অদিম ট্রাংক থেকে তার ফোনটি বের করে সীমকার্ড তুলে অন করে। সঙ্গে সঙ্গে অনেকগুলো মেসেজ আসতে থাকে। গতকাল রাতের আসা একটি মেসেজে চোখ আটকে যায় অদিমের।

‘আজ রাতেই আমার বিয়ে। আমি চেয়েছিলাম তুমি লেখক হও। তুমি হয়তো লেখক হয়েছো বটে, আমার হলে না।‘
ইতি
তোমার আল্পনা

কাঁপতে কাঁপতে মেঝেতে বসে পড়ে অদিম।

'চোখ বন্ধ করে আকাশের দিকে আর কত তাকিয়ে থাকবি অদিম।' হঠাৎ কাঁধে বন্ধু রুহানের হাতের ছোঁয়া পেয়ে ঘোর থেকে বেরিয়ে আসে অদিম। কতবছর তো কেটে গেলো অদিম এভাবে তোকে রোজ রোজ এই ওভার ব্রীজে এসে কষ্ট পেতে দেখে আমার অনেক খারাপ লাগে।

অদিম এখন এই কংক্রিটে মোড়ানো আলোর শহরের বিখ্যাত লেখক। তার লেখার নাম ছড়িয়ে গেছে দেশের আনাচে-কানাচে।

ওভারব্রীজে হাঁটতে হাঁটতে পকেট থেকে সিগারেট বের করে অদিমের দিকে এগিয়ে দিয়ে রুহান বলে ‘আচ্ছা লেখক সাহেব তোর লিখায় এত এত প্রাণ নাশ করিস তুই। তোর শাস্তি তবে কি?’

লাইটার নিভিয়ে সিগারেটে টান দিয়ে হাসতে থাকে অদিম। 'আরে বোকা আমি তো বন্দিশালায় বসেই লিখি।'