ছোটগল্পঃ কল্পচিঠি

অসীম কুমার কৌশিক
প্রকাশ: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৯:০২ ।
শিল্প ও সাহিত্য
পঠিত হয়েছে ১১ বার।

শিরশিরে বাতাসে দুলছে গাছের পাতা। আকাশে উজ্জ্বল চাঁদের আগমনে রাতের শোভা বেড়েছে। অঘোরে ঘুমন্ত এই নগরী কিভাবে দেখবে সে আলোয় কত আধাঁরের গল্প ভীড় জমিয়েছিলো। 

 

ঘড়ির কাঁটার টিকটিক শব্দ। আর কাগজে লিখার শব্দ। এভাবেই ১ যুগ ধরে রোজ গভীর রাতে ও তপ্ত দুপুরে চিঠি লিখে নীল। শুনশান চারদিক। টেবিল ল্যাম্পের মিটমিটে আলোয় মেঝেতে বসে উপুড় হয়ে চিঠি লিখছে নীল। তার কল্পনার সেই শ্যামা গড়নের কাশফুলের মতো হাস্যজ্বল মেয়েটিকে উদ্দ্যেশ্য করে আজও চিঠি লিখছে লিকলিকে চেহারার এই যুবক। 

 

প্রিয় কল্প,

 

মানুষ প্রেমে পড়ে মানবীর। আমি কোনো মানবীর প্রেমে পড়িনি। আমি প্রেমে পড়েছি আমার কল্পনায় ফুটে উঠা এক অমানবীর। সে তুমি। আমি বাস্তবে কখনো তোমায় দেখতে পাবো না। চাই না চোখের আলোয় দেখতে। তুমি থাকো, মনের আলোয়।

মা বলেছে আমার নাকি অনেক জটিল রোগ হয়েছে। বাইরে যাওয়া বারণ। তাই এই ঘরে বন্দী আমি। রোজ চিঠি লিখি তোমায়। 

কল্প, আমার মনের চিত্রপটে যে ছবি তোমার গাঁথা তা কখনো মুছে যাবার নয়। তোমাকে যখন ইচ্ছে আমি দেখতে পারি, তোমার সাথে গল্প করি। 

তোমাকে হারানোর ভয় নেই আমার, কিন্তু যদি বাস্তবে কখনো আসো? তখন তো হারিয়ে ফেলবো তোমায়। সেদিন আমার হৃদয় সমুদ্র মন্থনের গরলে ছেয়ে যাবে। তখন নীলাক্ত সে হৃদয় আমার এই অসার শরীরের ভার নিতে ব্যর্থ হবে। 

 

তুমি বাস্তবে এসো না প্রিয়া মানবী হয়ে

 কল্পনায় আমার থেকো

রেখো আমায় বাঁচিয়ে। 

 

ইতি

 

তোমার নীল,,,,

 

যত্ন করে চিঠিটা আলমারিতে রেখে দিয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন নীল। জানালা দিয়ে চাঁদ ছিটকে পড়েছে নীলের মুখে। আহা! পৃথিবীর সমস্ত মায়া যেন এই মুখ ঘিরে বেঁচে আছে।

 

আজ সকাল থেকেই নীলের মন ভীষণ খারাপ। কোনো এক অজানা ভয় তাকে গ্রাস করছে। দুপুরে চিঠি লিখতে বসেছে নীল। নিজেকে বড্ড হালকা মনে হচ্ছে। নিজের শরীর ভারমুক্ত মনে হচ্ছে। 

 

প্রিয়তমা কল্প,

 

তুমি বাস্তবে এসো না কখনো। আমি হয়তো,,,,,,

 

চিঠির লাইন শেষ না করতেই নীল বাইরে এক মায়াবী কণ্ঠের চিৎকার শুনতে পেলো৷ নীলের মা দৌড়ে জরাজীর্ণ পুরানো বাড়িটার বাইরে এলো। মেয়েটিকে বুকে জড়িয়ে কাঁদছেন তিনি। কি ব্যাপার, মা কাঁদছে কেন? কাঁদছে মেয়েটিও। কে এই মেয়ে?

 

নীল জীর্ণ বাড়িটার দুই তলার জানালায় দাঁড়িয়ে। মা নীলের দিকে হাত বাড়িয়ে কি যেন দেখিয়ে দিচ্ছে। এবার মেয়েটি নীলের দিকে তাকিয়ে। দু'চোখ তার অশ্রুতে পূর্ণ। 

 

চমকে পিছিয়ে যায় নীল। একি! কল্প তুমি? আমি হারিয়ে ফেললাম তোমায়। হারিয়ে ফেললাম আমায়। 

 

দরজা খোলার শব্দে চমকে উঠলো নীল। কল্প মায়ের হাত শক্ত করে ধরে কাঁদছে। কেন কাঁদছে? কল্প, শোনো কেঁদো না। এইতো আমি। কল্পকে ধরতে গিয়ে দেয়ালের দিকে ছিটকে গেলো নীল। শরীরহীন নীল কিভাবে ছোঁবে তার কল্পনার এই মানবীকে। সে সাধ্য নেই তার আত্মার।

 

কল্প: মা, নীল আমাকে চিঠি পাঠিয়েছিলো ঢাকা থেকে। কিন্তু সে চিঠি আমি পেয়েছি বিয়ের তিনদিন পর। আমি জীবন্ত লাশ হয়ে ছিলাম এতদিন। বাবা আমাকে জোর করে বিয়ে দিয়েছিলো। নীল আমায় চিঠিতে জানিয়েছিলো তার চাকরি হয়েছে। আমায় শীঘ্রই বিয়ে করবে।

এরপর তোমাদের ঠিকানায় দিয়ে দেখি তোমরা সেখানে নেই। লোকের মুখে জানতে পারি আমার নীল আর নেই। হন্নে হয়ে খুঁজেছি তোমাকে। 

 

নীলের মা: নীল চলে যাবার পর সেই বাড়ি ছেড়ে দিয়েছি। এখানে দোতলার এই জীর্ণ বাড়িতে উঠেছি। দুই তলার রুমটায় তোমার পাঠানো চিঠিগুলো আর নীলের ছবি রেখেছি। ওই ঘরে কাউকে যেতে দিইনি এতোদিন।  কল্প, তোমাকে চিঠি পাঠানোর পর নীল অনেক খুশী ছিলো। এক সপ্তাহ যায়, দুই সপ্তাহ যায়। এভাবে দিন যায়, দিন আসে। কিন্তু চিঠির উত্তর আসে না। তখন নীল সেই যে তোমার খোঁজে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেলো আর ফিরে আসেনি। এসেছে পরদিন লাশ হয়ে।

 

জানালার দিকে এগিয়ে যায় কল্প। বাইরে অপলক তাকিয়ে সে। কল্প দেখছে, চিঠি হাতে দৌঁড়ে আসছে নীল। 

'কল্প নীচে এসো, এই নাও তোমার চিঠি!'