জীবনে বগুড়া যাননি, সেখান থেকেই ‘গ্রেপ্তার’ হন কুমিল্লার যায়েদুর
পুণ্ড্রকথা ডেস্ক
বিগত সরকারের আমলে ধর্মীয় নেতাদের ওপর চালানো নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার মোহনপুর গ্রামের যায়েদুর রহমান। পরিবার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে তিনি থাকতেন নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে মৌচাক বাসস্ট্যান্ডের কাছে। ২০১৯ সালের ১০ এপ্রিল একদল লোক পুলিশ পরিচয়ে তাঁকে তুলে নিয়ে যায় সিদ্ধিরগঞ্জ থেকে।
প্রায় ২০ মাস গুম থাকার পর ২০২০ সালের ২৭ নভেম্বর যায়েদুরকে বগুড়ায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। তাঁর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদে যুক্ত থাকা, বিস্ফোরক ও অস্ত্র আইনে মামলা করে পুলিশ।
যায়েদুর বলেন, গুম হওয়ার আগে জীবনে কখনও বগুড়া যাননি। গুম হওয়ার আগে তাঁর নামে কোনো মামলাও ছিল না। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর সেপ্টেম্বরে দুটি মামলায় হাইকোর্ট থেকে, আর একটি মামলায় নিম্ন আদালত থেকে জামিন পান। আগে নারায়ণগঞ্জ থাকলেও এখন কুমিল্লায় বসবাস করছেন।
বর্তমানে যায়েদুর একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করছেন। তিনি বলেন, গুমের পর নাটক সাজিয়ে পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করে। মামলাগুলোর অভিযোগ গঠন হলেও এখনও কোনো সাক্ষ্য হয়নি। গুম কমিশন যে ২৫৩ জনের তালিকা করেছে, যাদের রাষ্ট্রীয় বাহিনী দ্বারা গুম হওয়ার বিষয়ে প্রমাণ মিলেছে, সে তালিকায় তাঁর নামও আছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আইসিটি) অভিযোগ দিয়েছেন, যা তদন্তাধীন।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের গুমের তালিকায় ৫৮ নম্বরে নিজের নাম থাকার কথা জানিয়ে এই শিক্ষক বলেন, সরকারের উচিত এসব হয়রানিমূলক মামলাগুলো প্রত্যাহার করা। মামলার কারণে প্রতি মাসে বগুড়ায় গিয়ে হাজিরা দিতে হয়। কেউ চাকরি দিতে চায় না। এখনও বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রথমে টাকার প্রলোভন এবং পরে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। তাঁর ভাইকেও হয়রানি করা হচ্ছে। গুমের সঙ্গে জড়িতরা বিভিন্নভাবে বাধা সৃষ্টি করছে। এখনও ভয় নিয়ে চলতে হচ্ছে। কারণ, গুমের সঙ্গে জড়িতরা নিজ পদে বহাল তবিয়তে আছেন। সব দিক মিলিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে বেগ পেতে হচ্ছে।
শুধু মুফতি যায়েদুর রহমান নন; গুমের শিকার যারা আয়নাঘর থেকে বেঁচে ফিরেছেন তাদের বেশিরভাগের নামেই রয়েছে একাধিক মামলা। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি মিললেও মামলার ভারে স্বাভাবিক জীবনে ফেরত যেতে পারেননি তারা। বিভিন্ন জেলায় মামলার হাজিরা দিয়েই দিন পার করছেন। গুম কমিশন তদন্ত করে প্রায় ২৫৩ জনের গুমের তথ্যের সত্যতা পেয়েছে। এ তালিকায় থাকা কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে সমকাল। তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই বর্তমানে মামলা চলমান।
প্রায় একই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার বোয়ালিয়া ইউনিয়নের ১ নম্বর কাঞ্চনতলা গ্রামের সাইরুল ইসলামের সঙ্গে। ২০১৭ সালের মার্চ মাসে র্যাব পরিচয়ে তাঁকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। দুই মাস ২০ দিন গুম থাকার পর তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এর পর সাইরুল জানতে পারেন, তাঁর নামে একটি অস্ত্র মামলা করা হয়েছে। ২০২৪ সালের জুনে তাঁর যাবজ্জীবন সাজার রায় হয়। এর পর থেকেই পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তবে ৫ আগস্টের পর অভিযোগ জানাতে গিয়েছিলেন গুম কমিশনে।
নিজের অভিজ্ঞতার বিষয়ে সাইরুল ইসলাম বলেন, র্যাব-৫-এর সদস্যরা তাঁকে তুলে নিয়ে যায়। এরপর ছেড়ে দিলেও দেওয়া হয় মিথ্যা মামলা। গুম কমিশনে গিয়ে সব কাগজপত্র দিয়ে অভিযোগ করেছেন। তবে এখনও এর কোনো প্রতিকার পাননি।
নিজ নিরাপত্তার স্বার্থে অনেক বিষয় এখনও গণমাধ্যমে প্রকাশ করতে ভয় পাচ্ছেন সাইরুল ইসলাম। তিনি বলেন, সাজা মাথায় নিয়ে এখন পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। পুলিশ প্রতিনিয়ত বাসায় গিয়ে পরিবারের সদস্যদের হয়রানি করছে। প্রধান ফটক ভেঙে ঘরে প্রবেশ করে তাঁকে না পেয়ে অন্যদের ভয়ভীতি দেখায়। সরকার, গুম কমিশন বা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) কোথাও থেকে কোনো সাহায্য পাচ্ছেন না।
গুমের শিকার ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলার হয়রানি নিয়ে জানতে চাইলে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ‘আমরা অনেক মামলা প্রত্যাহার করছি। প্রায় ১৫-১৬ হাজার মামলা প্রত্যাহার হয়েছে। গুমের শিকার ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা আছে কিনা– এ বিষয়ে আমি অবগত না। আমরা এ ধরনের বেশ কিছু মামলা প্রত্যাহার করেছি। যে কেউ আমাদের মামলার সুনির্দিষ্ট নম্বর দিতে পারে, আমরা সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যাহার করব।’ খবর দৈনিক সমকাল