বগুড়ার ঘটনায় যে ব্যাখা দিলেন সেই বিচারক

পুণ্ড্রকথা ডেস্ক
প্রকাশ: ২৮ মার্চ ২০২৩ ২২:৩৯ ।
প্রধান খবর
পঠিত হয়েছে ৪৯৮ বার।

স্কুলপড়ুয়া মেয়ের সহপাঠীর মাকে প্রকাশ্যে মাফ চাইতে বাধ্য করার অভিযোগ ওঠা বগুড়ার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ রুবাইয়া ইয়াসমিন সেই ঘটনার ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

 

 

মঙ্গলবার (২৮ মার্চ) গণমাধ্যমে পাঠানো এ বিবৃতি তিনি বলেন, আমার মেয়েকে জানুয়ারি মাসে ভিএম স্কুলে ভর্তি করি। সে অত্যন্ত মেধাবী ও শান্ত প্রকৃতির ছিল বিধায় ঐ স্কুলের স্থানীয় শিক্ষার্থী ও তার কয়েকজন বান্ধবীর সমন্বয়ে গঠিত একটি গ্রুপ তাকে সবসময় নতুন শিক্ষার্থী হিসেবে র‌্যাগিং ও বুলিং করে আসছিল।

তিনি আরও বলেন, তারা তাকে বলতো জজের মেয়ে ভাবধরে চুপ করে থাকে। তাদের মধ্যকার Clash Mitigate করার জন্য ২০ ফেব্রুয়ারি আমার মেয়ের জন্মদিনে একটি কেক কিনে পাঠাই। আমার মেয়ে ক্লাসের সকল শিক্ষার্থীদের নিয়ে কেক টি কেটে খায়।

 

তাছাড়া ২০ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন ক্লাসের আরও দুজন ছাত্রীর জন্মদিন ছিল বিধায় তাদেরকে ডেকে এনে তার কেকটি শেয়ার করে। কিন্তু মরিয়ম মাহি ও তার গ্রুপের মেয়েরা আমার মেয়ের সকলের সঙ্গে মিলেমিশে চলার বিষয়টি মেনে নিতে পারছিল না।

 

তার পরিপ্রেক্ষিতে ২০ ফেব্রুয়ারি  তাদের ক্লাসরুমের দরজা লাগিয়ে বলা হয় যে, ৫৩ থেকে ৫৭ রোল ক্লাসরুম ঝাড়ু দিবে। আমার মেয়ের ক্লাসের বান্ধবী যার রোল ৭ (মানসুরা) তাকে সহযোগীতার জন্য চেষ্টা করলে ঐ গ্রুপের মেয়েরা তাকে সহযোগীতা করতে নিষেধ করে।

 

উল্লেখ্য, ক্লাস ঝাড়ু দেওয়ার জন্য যে ঝাড়ুটি ব্যবহার করা হয় তা ফুলের ঝাড়ু নয় সুইপারদের জন্য তৈরিকৃত একটি বিশেষ ধরনের বড় ঝাড়ু যা অত্যন্ত ভারি। তাছাড়া বিশাল ক্লাসরুমের প্রতিটি বেঞ্চ তুলে তুলে বিশাল বড় ক্লাসরুমটি তাকে ঝাড়ু দেওয়ার নির্দেশ প্রদান করা হয়।

 

আমার মেয়ে তাদের ভয়ে ক্লাসের পেছনে অত্যন্ত ময়লা জায়গাটি ঝাড়ু দিতে গেলে মরিয়ম মাহি ও তার গ্রুপের ১২ জন মেয়েসহ মনিটরিং এর কয়েকজন মেয়ে (জয় বাংলা, জজের মেয়ে রুম ঝাড়ু দিচ্ছে, জজ সরকারের কামলা) স্লোগান দিতে থাকে।

 

এই পরিস্থিতিতে আমার মেয়ে ঝাড়ু রেখে ক্লাসের সামনের বেঞ্চে চুপ করে বসে থাকে। তখন মরিয়ম মাহি নামক ছাত্রী তার গ্রুপের ১২জন সদস্য নিয়ে তাকে ঘিরে ধরে এবং মরিয়ম মাহি ক্লাসরুমের দরজা লাগিয়ে দেয়। ওরা সবাই মিলে র‌্যাগিং ও বুলিং করতে থাকে এই বলে যে "জজের মেয়ে বলে রুম ঝাড়ু দেয় না, জজের মেয়ে ভাব ধরে ঘর ঝাড়ু দেয় না, জজ সরকারের কামলা"।

 

তখন আমার মেয়ে মরিয়ম মাহির কাছে জানতে চায় আমার মা সরকারের কামলা হলে তোমার আব্বু কি করে ? তখন মরিয়ম মাহি তাকে বলে তার বাবা ব্যবসায়ী। মরিয়ম মাহি ও তার গ্রুপের মেয়েরা মিলে আমার মেয়েকে কোন কথা বলতে দিচ্ছিল না। আমার মেয়ে বলতে থাকে আমার ডাস্ট এলার্জি আছে। এই বলতে বলতে আমার মেয়ের নাক দিয়ে রক্ত পড়তে শুরু করে এবং সে কান্না করতে থাকে।

 

আমার মেয়ে তখন ক্লাসের দরজা খোলা পেয়ে ক্লাস শিক্ষকের নিকট ছুটে যায়। তখন আমার মোবাইল ফোনে শ্রেণীর স্কুল শিক্ষিকা মুসলিমা ম্যাডাম কল দিলে আমি এজলাসে থাকার কারনে আমার অফিস সহায়ক শহিদুল ইসলাম ফোন রিসিভ করে। সে ফোন রিসিভ করে আমার নিকট এসে বলে ম্যাডাম আপনার মেয়ের নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে এবং কান্না করছে তাকে যেন নিয়ে আসি। আমি তখনই এজলাস মুলতবী করে চেম্বারে আসি এবং আমার সহায়ক শহিদুল ইসলামকে ও ড্রাইভার রায়হানসহ পাঠাই আমার মেয়েকে স্কুল থেকে নিয়ে আসার জন্য।

 

তখন শহিদুল ইসলাম স্কুলের টিচারদের রুম থেকে কান্নারত ও নাক থেকে রক্ত ঝরছে এ অবস্থায় আমার মেয়েকে অফিসে নিয়ে আসে। আমি তার নাক থেকে রক্ত পড়া অবস্থা এবং কান্নারত অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে যাই এবং তাকে জিজ্ঞাসা করি তার সঙ্গে কি হয়েছে? সে তখন ভীত অবস্থায় বলতে থাকে মা আমি আর এই স্কুলে ক্লাস করতে পারব না। মরিয়ম মাহি ও তার গ্রুপের ১২ জন মেয়ে শুধু আমাকে জজের মেয়ে, সরকারের চাকরের মেয়ে বলে র‌্যাগিং ও বুলিং করে এবং নিয়মিত মানসিক নির্যাতন করে।

 

তারপর আমি আমার মেয়েকে নিয়ে বাসায় চলে আসি ও তার হাতমুখ ধুয়ে দিয়ে ঔষধ খাওয়াই এবং শুয়ে থাকতে বলি। সেইদিন বিচারপতি স্যারের কোর্ট ভিজিট থাকায় আমি আমার মেয়েকে বাসায় একা রেখে পুনরায় অফিসে চলে আসি।

 

ঐ সময় মানসিক বিপর্যস্ত অবস্থায় আমার মেয়ে ফেইসবুকের স্টোরিতে একটি পোস্ট দেয়। উক্ত পোস্টটি আমি দেখার সাথে সাথে ডিলিট করে দেই। মরিয়ম মাহি, মেঘা ও আফ্রিদা উক্ত স্ক্রিন শটটি নিয়ে তাদের ফেইসবুক স্টোরিতে আমাকে ও আমার মেয়েকে নিয়ে অশালীন ভাষায় মন্তব্য করতে থাকে।

 

তাছাড়া তারা স্ক্রিন শটগুলো বগুড়া বালিকা ভিএম স্কুল ও জেলা বালক স্কুলের জয়েন্ট গ্রুপে ছেড়ে দেয় এবং বিভিন্ন ছেলেদের ট্যাগ করতে থাকে। বিষয়টি আমার মেয়ে জানালে আমি সাথে সাথে পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনে টেক্সটের মাধ্যমে জানাই যেন তারা অনলাইন থেকে পোস্টগুলো রিমুভ করে দেয়। পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন আমার মেসেজ পেয়ে ওসি অপারেশন বগুড়া মুন্নাফকে ও সদ্য যোগদানকৃত এডিশনাল এসপিকে জানায় যারা পরবর্তীতে আমাকে ফোন দেন।

 

আমরা মরিয়ম মাহি, মেঘা ও আফ্রিদার অবিভাবকে ফোন করে বিষয়টি জানাই কিন্তু পরেরদিন সকালেও তারা উক্ত স্ক্রিন শট ও স্টোরি যাতে মরিয়ম মাহি লিখে “আমাদের মা তো আমাদেরকে নৈতিক শিক্ষা দিছে যেটা আপনার মা দিতে ব্যর্থ আগে আপনি আপনার মাকে আমাদের মায়ের মত হইতে বলেন, হায়রে জাজ যার কোন ম্যানার্স নাই কোন ভদ্রতা মেয়েকে শিখাতে পারে নাই তিনি নাকি জাজ। ভাই তুই আগে ম্যানার্স শিখ নিজে বস্তি হয়ে আমাদের বলতে আসিস। ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কান্না করে তার আবার বড় বড় কথা ।

 

মেঘা তার স্টোরিতে মন্তব্য করে “তুইতো ম্যানার্স ই জানস না। কিসের জজের মেয়ে তুই আগে তোর মায়ের কাছ থেকে জেনে আয় ম্যানার কাকে কয়। আচ্ছা জজের বেটি অবশ্য তোর মা ই তো কিছু জানে না । তোকে কি শিখাবে। যার কোন ম্যানার নাই তাকে বলে জাজ"।

 

উক্ত স্ক্রিন শট গুলো আমি ডেপুটি কমিশনার বগুড়া ও এডিশনাল এসপিকে হোয়াটস অ্যাপে সেন্ড করে এগুলো অনলাইন থেকে রিমুভ করার জন্য অনুরোধ করি। আমি বিষয়টি ফোন দিয়ে বিজ্ঞ সি.জে.এম স্যারকে ও অবহিত করি। ঠিক ঐ মুহুর্তে ওসি অপারেশন মুন্নাফ আমার চেম্বারে আসে এবং তাকে সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন থেকে পাঠানো হয়েছে বলে জানান। ঠিক তখনই শ্রেণী শিক্ষিকা মুসলিমা ও তৎপরবর্তিতে প্রধান শিক্ষিকা রাবেয়া খাতুন আমাকে স্কুলে প্রধান শিক্ষিকার অফিসে আসতে বলেন।

 

আমি আমার সন্তানের শিক্ষাজীবনের কথা চিন্তা করে সেখানে যেতে রাজি হই। আমি বের হওয়ার সময় ওসি মুন্নাফ ও আমার সাথে বের হয়ে হেড মিস্ট্রেস এর চেম্বারে এসে হাজির হন। ঐখানে আমি বিজ্ঞ অবিভাবক আইনজীবী যার মেয়ে ঐ স্কুলেই পড়ে জনাব বকুলকে বসে থাকতে দেখি।

 

উনি বলেন যে, ওনাদের ডেকে আনা হয়েছে। তখন আমি, বিজ্ঞ আইনজীবী বকুল ও ওসি মুন্নাফ মরিয়ম মাহি ও আফ্রিদাকে তাদের গ্রুপ থেকে এবং ছেলেদের গ্রুপ থেকে স্ক্রিন শটগুলো সরানোর জন্য অনুরোধ করি এবং আজে বাজে মন্তব্য করতে মানা করি। কিন্তু তারা আমাদের কারও কথাতেই সায় দিচ্ছিল না।

 

তখন আমি হেড মিস্ট্রেসকে বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য অনুরোধ করে তার চেম্বার থেকে আমি, বিজ্ঞ আইনজীবী বকুল ও ওসি মুন্নাফ আমাদের অফিসের ব্যস্ততার কথা বলে বের হওয়ার সময় মরিয়ম মাহির মা আমাকে জড়িয়ে ধরে ফেলে এবং উনি বলেন যে, তার মেয়ে তার অবাধ্য। তার কথা শোনে না। তখন আমি তাকে মাথায় হাত বুলিয়ে বলি যে, আমি তার কষ্ট বুঝতে পারছি। ঠিক তখনই শ্রেণী শিক্ষিকা মুসলিমা ও হাসি বেগম উক্ত আবিভাবককে আমার পা ছোয়ার জন্য ইশাড়া-ইঙ্গিত ও মৌখিক নির্দেশ দিয়ে হাসাহাসি করতে থাকে।

 

তখন আমি, অভিভাবক বিজ্ঞ আইনজীবী বকুল ও ওসি মুন্নাফ তাকে নিবৃত করে ঐখান থেকে বের হয়ে আসি। আমি কাউকে পা ধরার নির্দেশ দেইনি বা পা ধরতে বাধ্য ও করিনি। ইহা একটি অন্যায়, অবিবেচক ও গর্হিত অভিযোগ।

 

আমার মেয়ে দীর্ঘ ৪ মাস যাবৎ মাহি ও আফ্রিদা নামক দুজন মেয়ের গ্রুপের মেম্বারদের র‌্যাগিং ও বুলিং এর শিকার। সে দীর্ঘদিন ধরে এই স্থানীয় ছাত্রীদের র‌্যাগিং ও বুলিং সহ্য করে আসছিল এবং তাদের সাথে মিলে মিশে থাকার চেষ্টা করে আসছিল। কিন্তু তারা সব সময় আমার মেয়েকে জজের মেয়ে, সে বেশি সুযোগ সুবিধা পায়, জজ আসলে সরকারের চাকর, জজ জনগনের কামলা, এসব বলে র‌্যাগিং ও বুলিং করে আসছে।

 

সত্য যে, আমি পাবলিক সার্ভেন্ট এবং জনগনের সেবায় নিয়োজিত কিন্তু একটি শিশুকে যার বয়স ১৩ বছর এক মাস তাকে তার মা জনগনের চাকর, জজ জনগনের কামলা, জয় বাংলা শ্লোগান দিয়ে র‌্যাগিং ও বুলিং করা একটি অন্যায় আচরণ।

 

ছাত্রীরা তাদের র‌্যাগিং ও বুলিং বিষয়গুলো যেন গণমাধ্যমের সম্মুখে চলে না আসে সেজন্য বিচারক ও তার মেয়েকে জড়িয়ে গণমাধ্যম ও স্যোশাল মিডিয়াতে অপপ্রচার চালাচ্ছে এবং বিচার বিভাগকে নিয়ে অপমানসূচক কথাবার্তা প্রচার করে জনমনে বিচারকদের বিরুদ্ধে অসন্তোষ তৈরি করছে।

 

আমি এতদিন আমার ও আমার শিশুকন্যার প্রাইভেসির কথা চিন্তা করে মিডিয়া থেকে দূরে ছিলাম এবং কোন বিবৃতি প্রদান করিনি। কিন্তু একটি মিথ্যা অপবাদ মাথায় নিয়ে চলা আমার জন্য কষ্টকর বিধায় আমি সত্য বিষয়টি তুলে ধরলাম।