ছোটগল্পঃ অমীমাংসিত আক্ষেপ

সমীর সরকার
প্রকাশ: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ২২:৫০ ।
শিল্প ও সাহিত্য
পঠিত হয়েছে ৩৪ বার।

গোলাপের পাপড়ির মত মোলায়েম ঠোঁট। আর সেই ঠোঁটে মন হরণের হাসি যে কাউকে কাবু করবে। সাথে নদীর ঢেউয়ের মত ঢেউ খেলানো চুল তারই পাশে কানে ঝুমকো, দুধে আলতা গায়ের রং সাথে মায়াবী মুখ যেন সাত আসমানের পরী নেমে এসেছে পৃথিবীতে।

কি রে মামা পিছনে আটকে কি দেখিস? দুইদিন পর বসন্ত বরণ, কত্ত কাজ বাঁকি আমাদের।

তমালের এমন কথায় আঁতকে ওঠে অভ্র। এতক্ষণ যেন কলেজ প্রাঙ্গনে এক পরির মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল সে। চোখের দৃষ্টি ফেরাতেই দেখে কেউ নেই সেখানে। তার এক পলক দৃষ্টির অনেক আগেই সেখান থেকে চলে গেছে তার কল্পনার পরী। সেদিকে যেন সে খেয়ালই করে নি।

এক চিলতে হাসি দিয়ে অভ্র বলে 'আরে কিছু না চল,চল অনেক কাজ বাকি হাতে মাত্র একদিন।'

বলেই দৌঁড়ে যায় সেখানে যেখানে তার কল্পনা আটকে গিয়েছিল। পা রাখতেই চোখ পড়ে এক ঝুমকোর উপর যা সে তার কল্পবতীর কানে  দেখেছিল। ঝুমকোটা হাতে নিয়ে আবার ডুবে যায় কল্পনার অতল সাগরে।

হাতে সময় নেই বলছিস আর নিজে দাঁড়িয়ে আছিস বলে কলেজ সাজানোর কাজে এগিয়ে যায় দুই বন্ধু। ঝুমকোটা পকেটেই রয়ে যায় অভ্রের।

কাজের চেয়ে যেন অভ্রের মন খুঁজে চলেছে সেই অপরিচিতা পরীকেই। বারবার মন ছুটে যাচ্ছে সেই অপরিচিতার কাছেই আর মনের মাঝে কবিতার সুর উঠছে-
'আমার মনের কল্পনায় তুমি এক কল্পবতী
কল্পনার চেয়েও তুমি যেন সুন্দর 
আমার অনুভবে মাখানো মায়াবতী
যাকে কল্পনার চেয়ে বেশি ভালবাসি।'

মামা তুই কি কাজ করবি? আর কি বিড়বিড় করে বলিস পাগলের মতো? তমালের এমন কথায় চেতনা থেকে বাস্তবে ফেরে অভ্র। মামা প্রেম যে পাগলের পাগলামীর থেকে আসে তুই কি বুঝবি? কি রে মামা বসন্ত না আসতেই তো দেখি তোর মনে বসন্তের ঢেউ লেগেছে বলেই দুই বন্ধু অট্ট হাসিতে মেতে উঠে কাজে মন দেয়। সেই কলেজের প্রথম দিন থেকেই তমাল- অভ্রের বন্ধুত্ব সোনায়-সোহাগা। তাই তাদের আড্ডাও জমে বেশ।

সারাদিনের কাজ সেরে বিকালে বাসায় ফেরে অভ্র। কাজ আর ক্লান্তিতে ভুলেই যায় সেই অপরিচিতার কথা। রাতে শোবার আগে পকেটে হাত দিতেই ঠোকা লাগে সেই ঝুমকোর সাথে। পকেট থেকে ঝুমকোটা বের করে কি যেন ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে সে। পরের দিন সকালে উঠে কলেজে গিয়েই সারা কলেজ জুড়ে খুঁজতে থাকে সেই কল্পনার মায়াবতীকে।

তুই এখানে?সেই কখন থেকে খুঁজছি তোকে। কালকের অনুষ্ঠান বিষয়ে স্যার কথা বলার জন্য তোকে খুঁজছে। বলেই হাতটা ধরে  নিয়ে যায় তমাল। আর খোঁজা হয় না সেই মায়াবতীকে।

মনের মধ্যে এক আকাশ পরিমাণ দুঃখ নিয়ে বাসায় ফেরে অভ্র আর ভাবতে থাকে সেই মেয়েকে। ভাবতে ভাবতেই সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। রাতের খাবার খেয়ে আবার ভাবনার অন্তরালে ডুবে যায় সে। আর মনে মনে বলতে থাকে কাল বসন্ত বরণ সেই সাথে ভালবাসা দিবস। এমন দিনে সে তার প্রথম ভালবাসার মানুষকে খুঁজে বের করে মনের কথা বলবে। ভাবতেই চিরকুট লেখে সে। অবশেষে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত ৩ টা। এক পলকে কেউ কতটা পাগল করে দিতে পারে ভাবতেই লজ্জা পায় অভ্রের।

অবশেষে আসে সেই প্রতীক্ষিত দিন। সকাল সকাল বেশ সাজুগুজু করে হলুদ পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে অভ্র। এই অভ্র, এই অভ্র এইদিকে আয় গলা ফাটিয়ে ডাকতেই থাকে তমাল। তবে আজকে যেন তার সেদিকে খেয়ালই নেই। আজকে তার একটায় লক্ষ্য সেই অপরিচিতা মায়াবিকে খুঁজে বের করা। সারা কলেজ ঘুরে, একটার পর একটা মেয়েদের দল ঘুরেও যখন দেখা মেলে না তখন চোখে খানিকটা সাগরের নোনা জল নিয়ে  চলে আসে সেই কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে যেখানে তার হৃদয় হরণ হয়েছিল। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষাও করে। হয়তো তার জীবনের শীত কাটিয়ে নতুন বসন্ত আসবে এই আশায়।

এইদিকে অনুষ্ঠান শুরুর কিছু বাকি। একের পর এক ফোন দিয়েই যাচ্ছে তমাল। তাই আর দেরি না করে চিরকুট আর কানের ঝুমকো সেখানেই রেখে অনুষ্ঠানে যোগ দেয় অভ্র। অনুষ্ঠানের প্রায় শেষ পর্যায়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে সেই কৃষ্ণচূড়া গাছ তলায় এসে দাঁড়ায় নিধি। কারণ বসন্তের আসল রূপ যেন কৃষ্ণচূড়ার ঢালেই ভর করে। আনমনা হয়ে কৃষ্ণচূড়ার ফুল দেখতে দেখতে চোখ আটকে যায় নিধির। আরে এটা তো তার সেই ঝুমকো যা একদিন আগে সে হারিয়েছে। ঝুমকো তুলতেই চোখ পড়ে ঝুমকোর নীচে থাকা চিরকুটে। বেশ কিছুটা বিষ্ময় নিয়েই চিরকুটটা খোলে সে।

সেখানে লেখা-

'ওহে কল্পনার মায়াবিনী, জানি না কে তুমি? শুধু জানি তুমি আমার হৃদয়হরিনী। যার কাজল কালো চোখে আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলতে চাই বারবার। তুমিই সেই যার ঠোঁটের মিষ্টি হাসির জন্য পৃথিবী জয় করতে পারি। যাকে পাওয়ার জন্য বসন্তকে এনে দিব বাসন্তি। তোমার পদতলে হাজার বসন্ত কাটিয়ে দিতে রাজি।'

চিরকুটটা পড়তে পড়তেই কোথায় যেন হারিয়ে যায় নিধি। নিজের মনে সেই অদেখা পুরুষের ছবি এঁকে ফেলে সে।

কি রে নিধি তুই এখানে আর আমি তোকে খুঁজে মরছি। মাইশার কথাতেই বাস্তবে ফিরে আসে সে। অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেছে? প্রশ্ন করে নিধি।

অনুষ্ঠান ১০ মিনিট আগে শেষ হয়েছে তারপর থেকেই তোকে খুঁজছি আর তুই কিনা এখানে? কি! ১০ মিনিট আগে!  বলেই অনুষ্ঠান যেখানে হয়েছে সেদিকে হাঁটা ধরে নিধি। আর খুঁজতে থাকে কাউকে। নিধিকে ডাকতে ডাকতেই ওর পিছু নেয় মাইশা।

ওদিকে বন্ধুদের জন্য রাস্তার ওপারে কোল্ড ড্রিংকস কিনতে যায় অভ্র। ড্রিংকস কিনে ফিরতে যাবে তখনই চোখ পড়ে সেই কল্পনার মায়াবিনীর উপর। হয়তো ভালবাসার প্রিয় মানুষটার উপর হাজার লোকের ভীডেও চোখ পড়ে। সৃষ্টিকর্তা হয়তো প্রকৃতির নিয়ম এমন করেই সাজিয়েছেন।

প্রিয় মানুষকে হারানোর ভয়ে দৌড়ে আসতে নেয় অভ্র। তখনই একটা ট্রাক এসে সজোরে ধাক্কা দেয়। সাথে সাথেই লুটিয়ে পড়ে সে। কান থেকে চিবুক বেয়ে আসা রক্তে রঞ্জিত হয় পিচ ঢালা কালো রাস্তাটি, চোখের কোনে জমে থাকে আক্ষেপের অশ্রু। মুহূর্তেই লোক জড়ো হতে থাকে সেখানে। বিষয়টি নজর এড়ায় না নিধির। সেও ছুটে আসে ঘটনাস্থলে। ভীড় ঠেলে সামনে গিয়ে চোখ দিতেই বুকের মধ্যে এক অজানা ব্যাথা অনুভব করে সে। এখানে এক নিমিষেই ঘটে যাওয়া ঘটনা সবাই দেখল কিন্তু এর আড়ালের ঘটনা অর্ন্তজামী ছাড়া কেউ বুঝলো না।

পরক্ষণেই তার চোখ যায় শহরের বুক চিড়ে বয়ে চলা রাস্তার উপরে। এতক্ষণে কংক্রিটের খটখটে রক্ত পিপাসু রাস্তা কৃষ্ণচূড়ার মত লাল রঙে সেজে উঠেছে। যেন বরণ করেছে বসন্তকে।প্রকৃতির আকাশে সন্ধ্যা নামে সাথে নিধির মনের আকাশেও। কিন্তু কেন এই অন্ধকার তা বুঝে আসে না তার।

এভাবে কেটে যায় বহু বসন্ত। প্রতিবছরের মতো এবারও নিধি এসে দাঁড়ায় সেই কৃষ্ণচূড়ার নীচে। প্রতিবারের ন্যায় ঝুমকোটা সেই জায়গাতেই রাখল, যেখান থেকে সে এটি চিরকুটসহ পেয়েছিল। গাছটা ঠিক আগের মতোই আছে শুধু বয়সটা বেড়েছে। এবারও বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে।

কি জানি! হয়তো ঝুমকোটা আগামীকাল আবার এখানেই পড়ে থাকবে ভাবতে ভাবতে বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটতে থাকে নিধি।

কিছু দূর গিয়ে পিছন ফিরে তাকায় সে। চোখ পড়ে কংক্রিটের সেই রাস্তায় যেখানে কয়েক বছর আগে রক্তাক্ত হয়েছিল। চিবুক বেয়ে অশ্রু নামে নিজের অজান্তেই।

কি অদ্ভুত না পৃথিবীটা! হৃদয়ের পাতায় শুরু হওয়া গল্পগুলো অমীমাংসিত রয়ে যায় অগোচরে।