আটকে গেল বগুড়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম
পুণ্ড্রকথা ডেস্ক
আইন পাসের প্রায় দুই যুগ হতে চললেও এখনো কার্যক্রম শুরু হয়নি বগুড়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ভিসি নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এজন্য কয়েকজন অধ্যাপকের জীবনবৃত্তান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখায় জমাও হয়েছিল। তবে শেষ মুহূর্তে শিক্ষা উপদেষ্টার এক চিঠির কারণে সেই কার্যক্রমও থমকে গেছে। এ অবস্থায় হতাশা ব্যক্ত করেছেন বগুড়ার সাধারণ মানুষ।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি সূত্র জানিয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আইন পাস হওয়া নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষা কার্যক্রম কিংবা ভিসি নিয়োগের বিষয়টি আপাতত স্থগিত রাখতে চিঠি দিয়েছেন শিক্ষা উপদেষ্টা। গত ১২ ডিসেম্বর ইউজিসি চেয়ারম্যান বরাবর চিঠিটি পাঠানো হয়। চিঠিতে যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী সংখ্যা কম, সেখানে আপাতত নতুন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ না করতেও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ বলেন, ‘বগুড়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি নিয়োগসহ নতুন প্রতিষ্ঠিত হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে শিক্ষা উপদেষ্টার দপ্তর থেকে একটি চিঠি পেয়েছি। চিঠি নিয়ে পরবর্তীতে উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা করা হবে।’
চিঠিতে শিক্ষা উপদেষ্টা বলেছেন, ‘বিগত সরকারের আমলে দেশের বিভিন্ন জেলায় অনেকগুলো নতুন বিশ্ববিদ্যালয় (সাধারণ ও বিশেষায়িত) স্থাপন করা হয়েছিল। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভবিষ্যতে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দাঁড়াতে পারবে কি না তা পরিষ্কার নয়। যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা-কার্যক্রম এখনো শুরু হয়নি সেগুলো নিয়ে পরবর্তী সময়ে যেকোনো পদক্ষেপ স্থগিত রাখাই বাঞ্ছনীয় বলে মনে করি। এ ছাড়া যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্বল্পসংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে, সেগুলোতেও নতুন শিক্ষক বা কর্মকর্তার পদ সৃষ্টি জরুরি প্রয়োজন না হলে এখন স্থগিত রাখাই ভালো। এসব বিষয়ে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নীতিগতভাবে পরবর্তী সরকারের ওপর সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার রেখে যাওয়া সমীচীন মনে করে।’
শিক্ষা উপদেষ্টার দপ্তর থেকে এমন চিঠি পাঠানোর কারণ জানতে মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখার একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস। তবে তারা কেউ নাম প্রকাশ করে বক্তব্য দিতে রাজি হননি। নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা জানান, ‘আওয়ামী লীগের আমলে আইন পাস হওয়ার কারণে শিক্ষা উপদেষ্টা নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চান না। নির্বাচনের পর যে সরকার আসবে, সেই সরকারের উপর এ দায়িত্ব দিতে চান। এজন্য তিনি ইউজিসিতে চিঠি পাঠিয়েছেন। নির্বাচিত সরকার না আসা পর্যন্ত বগুড়ায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন কিংবা বগুড়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি নিয়োগ হওয়ার সম্ভাবনা কম বলেও জানান তিনি।’
এদিকে দীর্ঘদিন ধরে বগুড়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম স্থগিত থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বগুড়ার শিক্ষাবিদ এবং সাধারণ মানুষ। তারা বলছেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নানাভাবে বঞ্চনার শিকার হয়েছে বগুড়াবাসী। সেই ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে। উত্তরবঙ্গের শিক্ষানগরী হওয়ার পরও বগুড়ায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তারা।
কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর মো রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এই অঞ্চলের (বগুড়া, নওগাঁ ও জয়পুরহাট) মানুষের দীর্ঘদিনের একটি প্রত্যাশা ছিল বগুড়ায় একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হবে। দেরিতে হলেও প্রায় দুই যুগ আগে জাতীয় সংসদে বগুড়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ পাশ হয়। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো কোনো এক অজ্ঞাত কারণে বিশ্ববিদ্যালয়টির কার্যক্রম অদ্যাবধি শুরু হয়নি। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে এসে উপাচার্য নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হলে এলাকাবাসীর মনে বিরাট আশার সঞ্চার হয়। কিন্তু সে প্রক্রিয়াটিও স্থগিত করা হয়েছে। বগুড়ার জনগণ কি এমন দোষ করেছে যার কারণে তারা উচ্চশিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। একটা কারণ হতে পারে এটা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জন্মস্থান। আর সে কারণেই যদি বগুড়া অবহেলিত থাকে তাহলে সেটা দুঃখজনক। আমি আশা করব বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়টির কর্যক্রম শুরুর জন্য তড়িৎ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’
আর কত বঞ্চনার শিকার হবে বগুড়া এমন প্রশ্ন তুলে নওগাঁ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক হাছানাত আলী বলেন, ‘২০০১ সালে বগুড়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন পাস হয়েছে। তবে দুঃখের বিষয় হলো-এখনো এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কার্যক্রমই শুরু হয়নি। এর ফলে বগুড়াবাসী চরমভাবে বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। একই সাথে বগুড়ার মানুষকে অপমানিত করা হয়েছে। এটি বৈষম্যহীন বাংলাদেশের অন্তরায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘বগুড়াকে শুধু বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই বঞ্চিত করা হয়েছে তা নয়; বিমানবন্দর, রেলপথ, সিটি করপোরেশনসহ প্রায় সব ক্ষেত্রেই বঞ্চিত করা হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে অনুরোধ, গত ১৮ বছর ধরে বগুড়াবাসীকে যেভাবে বঞ্চিত করা হয়েছে, সেটি থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি দিতে অবিলম্বে বগুড়ায় পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু করা হোক।’
শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়; সব ক্ষেত্রেই বৈষম্যের শিকার হয়েছে বগুড়া জানিয়ে বগুড়া-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত) মোশাররফ হোসেন বলেন, বগুড়ার মতো শিক্ষানগরীতে বিশ্ববিদ্যালয় নেই, এটি সবাইকে ব্যথীত করে। বগুড়ার স্কুল-কলেজ একাধিকবার রাজশাহী বোর্ডে সেরা হয়েছে। এখানকার ছেলে-মেয়েরা দেশসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেন। অথচ আমাদের এখানে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই। আশা করছি অচিরেই এই বৈষম্য দূর হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি, সিটি করপোরেশন, রেলপথ এবং বিভাগের দাবি পূরণ হবে।’
প্রসঙ্গত, ২০০১ সালের ১৫ জুলাই জাতীয় সংসদে বগুড়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হয়। আইন পাস হলেও বিভিন্ন বাধার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়টির কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ থাকে। পরবর্তীতে ২০২৩ সালের ১০ মে বগুড়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বাস্তবায়নের জন্য সরকার এসআরও জারি করে।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ৯ অক্টোবর বগুড়া জেলা প্রশাসক হোসনা আফরোজা বগুড়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগে চিঠি পাঠায়। এরপর মন্ত্রণালয় থেকে ভিসি নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হলেও শিক্ষা উপদেষ্টার চিঠির কারণে সেটি আবারও স্থগিত হয়ে গেছে।
সূত্র: দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস