বগুড়ায় বাড়ছে ভুয়া পরিচয়ে প্রতারণা: আতঙ্কে সাধারণ মানুষ

অরুপ রতন
প্রকাশ: ১২ জুলাই ২০২৫ ১৩:১২ ।
বিশেষ
পঠিত হয়েছে ৩২ বার।

বগুড়ায় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও রাজনৈতিক পরিচয়ের ভুয়া পরিচয় দিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করার প্রবণতা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত অন্তত সাতটি উল্লেখযোগ্য ঘটনায় দেখা গেছে প্রতারকরা কৌশলে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায়, ভয়ভীতি প্রদর্শন ও ব্ল্যাকমেইলের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করছে। এসব ঘটনায় অনেকেই মামলার মাধ্যমে আইনের আশ্রয় নিচ্ছেন, আবার অনেকে নিরাপত্তা ও লজ্জার কারণে মুখ খুলছেন না।


সবশেষ গত ৬ ও ৭ জুলাই ডিবি পুলিশের পরিচয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে টাকা আদায়ের ঘটনায় দুজন প্রতারককে গ্রেপ্তার করে জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন বগুড়ার দুপচাঁচিয়ার চৌধুরীপাড়া এলাকার শামীম আহম্মেদ এবং শহরের সুলতানগঞ্জ এলাকার মো. তাফসির। তাঁদের কাছ থেকে ওয়াকিটকি সদৃশ মোবাইল ফোন, ইলেকট্রনিক শক মেশিন, ভিজিটিং কার্ডসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়।

৭ জুলাই রাতে শিবগঞ্জ উপজেলার দাড়িদহ বাজার এলাকা থেকে আরও একজন ভুয়া ডিবি পুলিশ সদস্য রবিউল ইসলাম ডপিনকে গ্রেপ্তার করে শিবগঞ্জ থানা পুলিশ। তিনি নিজেকে গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধেও একাধিক মামলা রয়েছে।

এর একদিন আগে, ৬ জুলাই বগুড়া শহরের মালতিনগর এলাকায় প্রতারণার অভিযোগে একজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ, যিনি নিজেকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের চাচাতো ভাই হিসেবে পরিচয় দিতেন। ওই প্রতারক পরিচয় দিয়ে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন দলের নেতাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক আছে বলে দাবি করে বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছিলেন। প্রতারণার বিষয়টি জানাজানি হলে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে।

 

এর আগে, চলতি বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি একই উপজেলার কুপা মহাবালা এলাকায় প্রেমের সম্পর্কের ফাঁদে ফেলে এক তরুণ ও তরুণী মিলে পরিকল্পিতভাবে রবিউল ইসলাম ডপিনকে মোবাইলে ডেকে নেয় এবং ঘটনাস্থলে এসে তিনি নিজেই ডিবি অফিসার পরিচয়ে ২ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। ওয়্যারলেস সেট বের করে ভয় দেখানো হলে চিৎকার শুনে স্থানীয়রা ছুটে এসে পুলিশে খবর দেয়। পুলিশ এসে রবিউল ও তাঁর সহযোগী সুমি আক্তারকে আটক করে।


৯ মার্চ শহরের নারুলী এলাকায় পুলিশ পোশাক পরে সাব-ইন্সপেক্টর পরিচয়ে চাঁদাবাজি করছিলেন জাকারিয়া সরকার নামের এক প্রতারক। পুলিশ তাঁকে হাতেনাতে ধরে ফেলে। পরে জানা যায়, তিনি প্রায় দুই বছর ধরে বিভিন্ন দোকানে ভয় দেখিয়ে চাঁদা আদায় করতেন।


৬ মে সেনাবাহিনীর একটি দল শহরের টিনপট্টি ও শাকপালা এলাকায় অভিযান চালিয়ে সেনা ও পুলিশে চাকরি দেওয়ার ভুয়া আশ্বাস দিয়ে অর্থ আত্মসাৎকারী চক্রের দুই সদস্য তাহের আলী ও বায়েজিদ মিয়াকে আটক করে। তাদের কাছ থেকে চাকরিপ্রত্যাশীদের সনদ, ফাঁকা স্ট্যাম্প ও চেক জব্দ করা হয়। উদ্ধার করা হয় শিবগঞ্জের মোকামতলার এক তরুণকেও।

সবচেয়ে ভয়ঙ্কর একটি ঘটনা ঘটে ১২ এপ্রিল। র‌্যাব-১২-এর একটি দল সদর উপজেলার দারিয়াল হাজরাদিঘী গ্রাম থেকে শিহাব হোসেন সাগর (২১) নামের এক যুবককে গ্রেপ্তার করে। তিনি র‌্যাব সদস্য পরিচয়ে নারীদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে তোলে, ভিডিও কলে গোপন মুহূর্ত ধারণ করে ব্ল্যাকমেইল করতেন। তাঁর কাছ থেকে ২টি স্মার্টফোন, সিপিইউ, হার্ডডিস্ক, দেশীয় অস্ত্র ও মেমোরি কার্ডসহ বিভিন্ন আলামত জব্দ করা হয়।

এইসব ঘটনায় সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। বগুড়া শহরের আব্দুর রহমান নামে এক ব্যবসায়ী বলেন, “এখন আর বোঝা যায় না কে আসল, কে নকল। কেউ যদি পুলিশ সেজে এসে কিছু দাবি করে, আমরা আতঙ্কে প্রতিবাদও করতে পারি না।”

সুশাসনের জন্য নাগরিক( সুজন) বগুড়ার সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন ইসলাম তুহিন বলেন, 'প্রতারণার ধরন এখন ডিজিটাল ও কৌশলী হয়েছে। এটি শুধু আইনশৃঙ্খলা নয়, সামাজিক মূল্যবোধেরও হুমকি। এটা আমাদের জন্য উদ্বেগের বিষয়। প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে এই প্রতারকরা বার বার সুযোগ নিচ্ছে।'

বগুড়ার পুলিশ সুপার জেদান আল মুসা বলেন, 'প্রতারকরা যতই ছদ্মবেশ নিক, আমরা তাদের ধরছি এবং আইনের আওতায় আনছি। সাধারণ মানুষ যেন ভয় না পায়, সেই পরিবেশ নিশ্চিত করতে পুলিশ কাজ করছে। যেকোনো সন্দেহজনক ঘটনার খবর পুলিশকে দিতে হবে।'

তিনি আরও বলেন, 'ভুয়া পরিচয় দিয়ে কেউ যেন প্রতারণা করতে না পারে, সে জন্য আমরা থানাগুলোকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছি। সামাজিক সচেতনতা এবং দ্রুত আইনি ব্যবস্থা এই দুই পথেই প্রতারকদের রুখে দেওয়া সম্ভব।'