বগুড়ায় বনানী- চান্দাইকোনা ছয় লেনের মহাসড়ক, অথচ মৃত্যু ফাঁদ

অরুপ রতন
প্রকাশ: ১২ জুন ২০২৫ ১৬:৪৮ ।
বিশেষ
পঠিত হয়েছে ৮৫ বার।

ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কের বগুড়ার বনানী থেকে সিরাজগঞ্জের চান্দাইকোনা পর্যন্ত মাত্র ৪২ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কে ভয়াবহ হারে বেড়েছে সড়ক দুর্ঘটনা। মাত্র পাঁচ মাসের কিছু বেশি সময়ে, অর্থাৎ ১৬২ দিনে ১৮টি দুর্ঘটনায় ২২ জনের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত ১৪ জন। নিহতদের মধ্যে শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ পর্যন্ত রয়েছে।

 

স্থানীয়রা বলছেন, সড়কে ডিভাইডার না থাকা, অদক্ষ ও অশিক্ষিত চালকের বেপরোয়া গতির যানবাহন, লাইসেন্সবিহীন পরিবহন এবং পর্যাপ্ত ওভারপাস না থাকায় প্রতিদিনই নতুন করে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। অথচ এসব দুর্ঘটনা রোধে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ তাদের। 

 

প্রাণহানির হিসাব ভয়াবহ

 

বগুড়া হাইওয়ে পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে ১১ জুন পর্যন্ত শেরপুর হাইওয়ে পুলিশ ক্যাম্পের আওতাধীন বনানী থেকে চান্দাইকোনা পর্যন্ত মহাসড়কে ঘটেছে মোট ১৮টি দুর্ঘটনা। এতে প্রাণ গেছে ২২ জনের, আহত হয়েছেন কমপক্ষে ১৪ জন।

 

বিশ্লেষণে দেখা যায়— সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা হয়েছে মার্চে । এই মাসেই ৮জন নিহত হন। এছাড়া জানুয়ারি মাসে তিনজন নিহত এবং একজন আহত, ফেব্রুয়ারি মাসে একজন নিহত, এপ্রিল মাসে ৪জন নিহত এবং একজন আহত, মে মাসে তিনজন নিহত এবং ৫জন আহত হন। আর চলতি মাসের ১১ তারিখ পর্যন্ত এই মহাসড়কে তিনজন নিহত এবং ছয়জন আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে ঈদের দিন নামাজ পড়তে যাওয়ার সময় শাজাহানপুর উপজেলার নয়মাইল এলাকায় বাস চাপায় নিহত হন মো. চাঁন মিয়া ও তার পাঁচ বছরের ছেলে মো. আবদুল্লাহ। চাঁন মিয়া নিজেও পেশায় একজন বাসচালক ছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন নাবিল পরিবহনে চাকরি করেছেন। এই ঘটনায় ঘাতক চালক আটক হলেও বাকি দুর্ঘটনাগুলোর বেশিরভাগেরই কোনো বিচার হয়নি।

 

ছয় লেনের মহাসড়ক, অথচ মৃত্যু ফাঁদ

 

বগুড়া শহরের বনানী মোড় থেকে শুরু করে শেরপুর উপজেলার চান্দাইকোনা পর্যন্ত ছয় লেনের মহাসড়কটি নির্মিত হলেও নিরাপত্তা নিশ্চিতে নেই তেমন কোনো ব্যবস্থা। এই ৪২ কিলোমিটার পথে একাধিক ঝুঁকিপূর্ণ স্থান রয়েছে যেখানে প্রতিনিয়ত ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য স্থানগুলো হলো—বেতগাড়ী, সাজাপুর, টিএমএসএস ফিলিং স্টেশন, শাজাহানপুর উপজেলা ভবন, নয়মাইল, জামালপুর, দশমাইল, শেরুয়া, মৎস্য খামার, ধর্মোকাম, যমুনাপাড়া, মির্জাপুর, রানীরহাটমোড় প্রভৃতি।

 

বহু জায়গায় সড়কের ওপর সঠিকভাবে ডিভাইডার না থাকায় যত্রতত্র পারাপার করছে পথচারীরা। আবার যেসব এলাকায় ফুটওভার ব্রিজ রয়েছে, সেখানেও সাধারণ মানুষ তা ব্যবহার করছে না—ফলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে।

 

শুধু তাই নয়, অনেক এলাকায় সড়কের পাশে বাজার, দোকান ও আবাসিক এলাকা থাকায় স্থানীয়রাও নিয়ম ভেঙে রাস্তা পার হচ্ছেন। কিছু এলাকায় সিএনজি, অটোরিকশা, মোটরসাইকেলসহ ছোট যানবাহন উল্টো পথে চলাচল করে। বিশেষ করে শেরপুর শহরের ধুনটমোড় থেকে উপজেলা মোড় পর্যন্ত অংশে ফ্লাইওভার না থাকায় যানবাহনের চাপ বেশি এবং ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাও দুর্বল।

 

চালক-যাত্রীর চোখে কারণগুলো

 

দুর্ঘটনা বাড়ছে, প্রাণ ঝরছে, পরিবারে চলছে শোকের মাতম। অথচ কেউ দায় নিচ্ছে না। যে সড়ক উন্নয়নের জন্য কোটি কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে, সেই সড়কই যেন আজ মৃত্যুফাঁদ। স্থানীয়দের দাবি—আর কোনো মা যেন সন্তানের লাশ গুনতে না হয়, তার আগেই চাই কার্যকর ব্যবস্থা।

 

নয়মাইল এলাকার বাসিন্দা রাজা মিয়া বলেন, 'এই রোডে গাড়ীগুলো মনে হয় প্লেন চালায়। এত গতি দিয়ে গাড়ী চলাচলের কারণে আমাদের এলাকায় দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে।'

 

বগুড়া থেকে ঢাকাগামী যাত্রী মাসুদ রানা বলেন, “ড্রাইভারদের অসচেতনতা, প্রতিযোগিতা, ও অতিরিক্ত গতির কারণেই দুর্ঘটনা বাড়ছে। মানুষ মরছে, অথচ কেউ দায় নিচ্ছে না। আমরা এর স্থায়ী সমাধান চাই।”

 

বাসচালক ইদ্রিস আলী জানান, “ছয় লেন হয়ে যাওয়ার কারণে আমরা গতি বাড়িয়ে দেই। সময় বাঁচাতে গিয়ে ঝুঁকি নিচ্ছি। কিন্তু কখন কী হয়ে যায় বলা যায় না।”

 

ট্রাকচালক বেলাল হোসেন বলেন, 'যারা ড্রাইভিং করে তাদেরও ভুল আছে। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয় তিনচাকার যানবাহন ও মোটরসাইকেল চলাচলে। মহাসড়কে যে পরিমাণ তিন চাকার যানবাহন ও মোটরসাইকেল চলে, তারা কোন নিয়ন্ত্রণ মানে না। এজন্য পরিবহন চালকদেরও সমস্যায় পড়তে হয়।'

 

নিসচা ও পুলিশের ভাষ্য

 

নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) বগুড়া জেলার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আব্দুস সালাম বাবু বলেন, “মহাসড়কে যারা ড্রাইভ করে, তাদের বড় অংশই মাদকাসক্ত। মালিকরা কম খরচে অদক্ষ চালক দিয়ে গাড়ি চালায়। চালকরা গতি নিয়ন্ত্রণে রাখেন না। ফলে প্রতিদিন ঘটছে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। শুধু মামলা বা জরিমানা নয়, প্রয়োজন কঠোর তদারকি, চালকের প্রশিক্ষণ ও জবাবদিহিতা।”

 

হাইওয়ে পুলিশ বগুড়া রিজিয়নের অতিরিক্ত ডিআইজি শহিদ উল্ল্যাহ বলেন, “সড়ক প্রশস্ত হওয়ায় চালকেরা বেপরোয়া গতি ত্বরান্বিত করছে। একদিকে তারা গতিসীমা লঙ্ঘন করছে, অন্যদিকে পথচারীরাও নিয়ম মানছে না। আমরা নিয়মিত চেকপোস্ট, মনিটরিং ও মামলা দিয়ে থাকি। কিন্তু শুধু পুলিশি পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়। চালক, মালিক, যাত্রী—সবার সচেতনতা জরুরি।”