আমদানির খরচ কমাচ্ছে বগুড়ার মসলা গবেষণা কেন্দ্র: ৩০ বছরে উৎপাদন বেড়েছে ১০ গুণ
অরুপ রতন
দেশে মসলার চাহিদা বাড়ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে চাষও। আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে দেশে উৎপাদিত মসলার মাধ্যমে চাহিদা মেটাতে নিরব বিপ্লব ঘটিয়ে চলেছে বগুড়ার শিবগঞ্জে অবস্থিত মসলা গবেষণা কেন্দ্র। কৃষকের হাতে উন্নত জাত পৌঁছে দিয়ে, আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে সহায়তা করে এবং বীজ থেকে শুরু করে বাজারজাতকরণ পর্যন্ত পরামর্শ দিয়ে দেশের একমাত্র এই প্রতিষ্ঠান মসলার জগতে বড় পরিবর্তন এনেছে।
এক সময় দেশে বছরে ৩ লাখ মেট্রিক টনের মতো মসলার উৎপাদন হতো। জমি ছিল মাত্র দেড় লাখ হেক্টরের মতো। এখন দেশে বছরে উৎপাদন হচ্ছে ৫১ লাখ টনের বেশি, আর জমির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫ লাখ হেক্টরে। উৎপাদনের এই বিশাল পরিবর্তনের পেছনে বড় অবদান রেখেছে মসলা গবেষণা কেন্দ্র।
১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) অধীনে শিবগঞ্জে প্রতিষ্ঠা করা হয় মসলা গবেষণা কেন্দ্র। পরের বছর থেকেই চালু হয় পূর্ণাঙ্গ গবেষণা কার্যক্রম। ৩০ বছর ধরে তারা কাজ করে যাচ্ছে দেশের উপযোগী জাত উদ্ভাবনে। এখন পর্যন্ত ২৭ ধরনের মসলাজাতীয় ফসলে ৫৮টি উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে এই কেন্দ্র। এর মধ্যে রয়েছে পেঁয়াজের ৭টি জাত, মরিচ, রসুন, আদা, হলুদ, ধনিয়া, কালোজিরা, মেথী, মৌরি, ফিরিঙ্গী, দারুচিনি, চুইঝাল, আলুবোখারা, লবঙ্গসহ আরও অনেক মূল্যবান মসলা।
এই জাতগুলো এখন কৃষকের মাঠে সাফল্যের সঙ্গে চাষ হচ্ছে। ফলনও আসছে আশানুরূপ। চাষের খরচ কমছে, লাভ বাড়ছে—ফলে আগ্রহী হচ্ছেন নতুন কৃষকরাও।
প্রথমবারের মতো দেশে ভেনিলা চাষেও সফলতা এসেছে এখানেই। বস্তায় আদা চাষ, বাণিজ্যিকভাবে জাফরান, কালো এলাচ, গোলমরিচ উৎপাদনের সম্ভাবনাও জাগিয়ে তুলেছে কেন্দ্রটি। আরও যেসব মসলা নিয়ে গবেষণা চলছে তার মধ্যে রয়েছে লেমনগ্রাস, একাঙ্গী, পোলাও পাতা, অলস্পাইস, চিভস, কাবাবচিনি, পেস্তা, জয়ফল, আমআদা, পান বিলাস, কারিপাতা প্রভৃতি।
শুধু জাত উদ্ভাবন নয়, মাঠপর্যায়ে চাষ সহজ করতে আধুনিক প্রযুক্তিও উদ্ভাবন করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এখন পর্যন্ত ১৫৬টি উন্নত কৃষি প্রযুক্তি তারা তৈরি করেছে। যার মধ্যে আছে—উৎপাদন কৌশল, মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা, পানি ব্যবস্থাপনা, পোকামাকড় ও রোগবালাই দমন, পরবর্তী প্রক্রিয়াজাতকরণ (পোস্ট হারভেস্ট) প্রযুক্তি। পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ, আদা ও রসুনের গুঁড়া তৈরির প্রযুক্তিও এখান থেকেই এসেছে।
শিবগঞ্জের কৃষক রেজাউল করিম বলেন, “গবেষণা কেন্দ্র থেকে সহজে উন্নত মানের বীজ পাচ্ছি। সেই বীজ মাঠে লাগিয়ে ভালো ফলন আসছে। এখন আমরা নিজেরাও বীজ সংরক্ষণ করি, ছড়িয়ে দিই।”
কৃষি উদ্যোক্তা সামিউল ইসলাম বলেন, “গত বছর জিরা চাষে ভালো ফলন হয়েছিল। নিজের জন্য বীজ রেখে আশপাশের কৃষকদেরও দিয়েছি। এখন তারা আগ্রহ নিয়ে চাষ করছে।”
গবেষণা কেন্দ্রের সরেজমিন গবেষণা বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ড. মাহমুদুল হাসান সুজা বলেন, “আমরা শুধু বীজ দিয়ে থেমে থাকি না। সার, কীটনাশক, চাষ পদ্ধতি—সব বিষয়ে কৃষকদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। তারা যেন নিজেরাই আত্মনির্ভর হতে পারেন, সেটাই লক্ষ্য।”
প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. জুলফিকার হায়দার প্রধান বলেন, “আমাদের দেশে আগে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে মসলা আমদানি করতে হতো। এখন যেসব জাত আমরা চাষে এনেছি, সেগুলোর কারণে উৎপাদন অনেক বেড়েছে। আমদানির খরচ অর্ধেকে নেমে এসেছে। চাষ আরও বাড়লে আমরা পুরোপুরি স্বনির্ভর হতে পারব।”