প্রকল্পের নামে সাড়ে ১৫ বছর মূলা ঝুলিয়েও উদ্যোক্তাদের দমিয়ে রাখা যায়নি

উত্তরের বিসিকগুলোতে পণ্য উৎপাদন এবং রাজস্ব আদায়ে শীর্ষে বগুড়া: শিল্প পার্ক হলে বিপ্লব ঘটবে

বিশেষ প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২১ জানুয়ারী ২০২৫ ১৭:৩২ ।
বিশেষ
পঠিত হয়েছে ৪৬ বার।

বগুড়ায় কল-কারখানা স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় জায়গা বরাদ্দ চেয়ে শিল্পোদ্যোক্তারা বছরের পর বছর ধরে বিগত সরকারগুলোর কাছে অনেক কাকুতি-মিনতি করেছেন। কিন্তু কথিত আশ্বাস ছাড়া কিছুই মেলেনি। সর্বশেষ শেখ হাসিনার সরকার তো ‘দ্বিতীয় বিসিক শিল্পনগরী’ এবং ‘শিল্প পার্ক’ স্থাপনের নামে উদ্যোক্তাদের সামনে রীতিমত মূলা ঝুলিয়ে রেখেছিল। তবে তাঁর সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে কলকারখানা করার মত এক ফুট জায়গাও বরাদ্দ মেলেনি।

 


অবশ্য এত কিছুর পরেও বগুড়ার শিল্পোদ্যোক্তারা দমে যাননি। বরং স্বল্প পূঁজিতে স্থানীয় বিসিক শিল্পনগরীর অল্প জায়গাকেই কাজে লাগিয়ে তারা ব্যাপক চাহিদা সম্পন্ন পণ্যগুলোকে টার্গেট করে সেগুলোর উৎপাদন শুরু করেন পাশাপাশি বাজারে টিকে থাকার কৌশল হিসেবে তারা পণ্যগুলোর উৎপাদন ব্যবস্থাকেও আধুনিকায়নে মনোযোগী হন। ফলশ্রæতিতে বছর ভিত্তিক পণ্য উৎপাদন এবং সরকারকে আয়কর, ভ্যাট, শুল্ক এবং খাজনাসহ রাজস্ব প্রদানের ক্ষেত্রে উত্তরাঞ্চলে সবগুলো বিসিক শিল্পনগরীগুলোকে পেছনে ফেলতে সক্ষম হয়েছে। পাশাপাশি বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতেও তুলনামূলক ভাল অবস্থান তৈরি করেছে। বিনিয়োগ এবং কারখানা ভিত্তিক কর্মসংস্থানে বগুড়া এখন দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে।

 


তবে স্থানীয় বণিক সমিতি এবং সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ বলছেন, যদি শিল্পোদ্যোক্তাদের  চাহিদা অনুযায়ী এখানকার বিসিক শিল্পনগরীকে সম্প্রসারণ কিংবা একটি শিল্প পার্ক নির্মাণ করা হতো তাহলে শিল্পায়নের ক্ষেত্রে বগুড়ার উদ্যোক্তারা শুধু উত্তরাঞ্চলেই নয় বরং সারা দেশে বিপ্লব ঘটাতেন। তারা অবিলম্বে বগুড়ায় বিসিকের প্রস্তাবিত শিল্প পার্ক নির্মাণের দাবি জানিয়ে বলেছেন, এখানকার শিল্পোদ্যোক্তাদের সঙ্গে অতীতে অনেক বৈষম্য করা হয়েছে। আর বিলম্ব নয়। জরুরী ভিত্তিতে এখানে বিসিকের শিল্প পার্ক নির্মাণ করতে হবে। তাতে বগুড়া তথা উত্তরাঞ্চলের অর্থনৈতিক চিত্রই পাল্টে যাবে।

 


সংশ্লিষ্ট দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, উত্তরাঞ্চলে সর্বপ্রথম বিসিক শিল্পনগরী গড়ে ওঠে বগুড়ায় ১৯৬০ সালে। এর দু’ বছরের মাথায় ১৯৬২ সালে রাজশাহী, পাবনা ও দিনাজপুরে এবং ১৯৬৭ সালে রংপুরে বিসিক শিল্পনগরী গড়ে তোলা হয়। রাজশাহী এবং রংপুর বিভাগের মোট ১৬টি জেলার মধ্যে অন্য ১১টি জেলায় ১৯৮৪ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে বিসিক শিল্প নগরীগুলো পর্যায়ক্রমে গড়ে তোলা হয়। এর মধ্যে ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৯ সালের মধ্যে গড়ে তোলা হয় নীলফামারী (সৈয়দপুর উপজেলা সদরে অবস্থিত), নাটোর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ বিসিক শিল্পনগরী। আর পঞ্চগড়, জয়পুরহাট, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ এবং নওগাঁয় বিসিক শিল্পনগরী গড়ে তোলা হয় ১৯৯১ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে। তবে বিনিয়োগ, পণ্য উৎপাদন, কর্মসংস্থান এবং সরকারকে রাজস্ব প্রদানের ক্ষেত্রে উত্তরাঞ্চলের ১৬টি বিসিক শিল্পনগরীর মধ্যে স্বাধীনতার পূর্বে নির্মিত বগুড়া, রাজশাহী, পাবনা, দিনাজপুর ও রংপুর অন্য ১১টির চেয়ে অনেক এগিয়ে রয়েছে। উত্তরাঞ্চলে প্রাচীন ৫টি বিসিক শিল্পনগরী কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, পণ্য উৎপাদন এবং সরকারকে রাজস্ব প্রদানের ক্ষেত্রে বগুড়ার অবস্থান এখন সবার শীর্ষে। মাত্র ৩৩ দশমিক ১৭ একর জায়গা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত বগুড়া বিসিক শিল্পনগরীর সচল ৯০টি কল-কারখানায় প্রতি বছর প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার পণ্য উৎপাদন হচ্ছে আর শিল্প মালিকরা সরকারকে প্রতি বছর রাজস্ব দিচ্ছেন ১৭০ কোটি টাকা। বগুড়া বিসিক শিল্পনগরীতে শিল্প খাতে বিনিয়োগ হয়েছে ৮৬৫ কোটি টাকা। 

 


উত্তরাঞ্চলে আয়তনের দিক থেকে বৃহৎ পাবনা শিল্পনগরীতে ১৮৩টি কারখানায় বছরে ৭৬৫ কোটি টাকার পণ্য উৎপান করা হয় আর সর্বশেষ আর্থিক বছরে ৮৭ কোটি টাকার রাজস্ব পরিশোধ করা হয়েছে। ওই শিল্পনগরীতে বিনিয়োগের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি ১ হাজার ৮৮৩ কোটি টাকা। পণ্য উৎপাদনে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে দিনাজপুরের বিসিক শিল্পনগরী। ২৮ দশমিক ৭৪ একর আয়তনের ওই শিল্পনগরীর ৫৪টি কারখানায় প্রতি বছর ৩৪৪ কোটি টাকার পণ্য উৎপাদিত হয়। সর্ব উত্তরের ওই জেলার বিসিক শিল্পনগরী সর্বশেষ অর্থ বছরে সরকারকে ৩ কোটি ৪ লাখ টাকার রাজস্ব দিয়েছে। সেখানে উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগের পরিমাণ ২৬৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা।

 


উত্তরাঞ্চলের পুরানো অপর দুই শিল্পনগরীর মধ্যে ৯৬ একর জায়গা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত রাজশাহীতে ১৮৭টি কলকারখানায় বার্ষিক উৎপাদনের হালনাগাদ কোন তথ্য ওই দপ্তরের কর্মকর্তারা দিতে পারেননি। তবে ওই শিল্পনগরী সর্বশেষ অর্থ বছরে সরকারকে ৬০লাখ টাকা রাজস্ব পরিশোধ করেছে। বিভাগীয় শহরের ওই শিল্পনগরীতে কল-কারখানা স্থাপনে বিনিয়োগ হয়েছে ৩০৬ কোটি টাকা। অপর বিভাগীয় শহর রংপুরে ২০ দশমিক ৬৮ একর জায়গার ওপর নির্মিত বিসিক শিল্পনগরীতে সচল ২৭টি কারখানায় বছরে ৭ কোটি ২০ লাখ টাকার পণ্য উৎপাদিত হয়। সর্বশেষ অর্থ বছরে ওই শিল্পনগরী থেকে সরকারকে ৪৩ কোটি টাকার রাজস্ব পরিশোধ করা হয়েছে। রংপুর শিল্পনগরীতে মোট ১ হাজার ১৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন শিল্পোদ্যোক্তারা।

 


তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, উল্লেখিত ৫টি বিসিক শিল্পনগরীর মধ্যে কারখানা ভিত্তিক কর্মসংস্থানে শীর্ষে রয়েছে পাবনা বিসিক শিল্পনগরী। সেখানে সচল ১৮৩টি শিল্প ইউনিটে মোট ১২ হাজার নারী-পুরুষ কর্মরত। অর্থাৎ প্রতিটি কারখানায় গড়ে ৬৫জন করে কাজের সুযোগ পেয়েছেন। অন্যদিকে বগুড়ায় সচল মাত্র ৯০টি কল-কারখানায় ৫ হাজার ৫০০ জন কাজ করছেন। ওই হিসেবে বগুড়ার একেকটি কারখানায় গড়ে ৬১জনের কাজের সুযোগ হয়েছে। রাজশাহী বিসিক শিল্পনগরীর চালু ১৮৭টি শিল্প ইউনিটে মোট ৯ হাজার ৯৬১জন কাজ করছেন। গড় হিসাবে দেখা গেছে সেখানে প্রতিটি কারখানায় ৫৩জন নারী-পুরুষের কাজের সুযোগ পেয়েছেন। এছাড়া দিনাজপুরে ৫৪টি কারখানায় ৪ হাজার ৮২৫জন এবং রংপুরে ২৭টি কারখানায় কাজ করছেন ১ হাজার ৩০০ শ্রমিক।

 


বঞ্চনার অবসান চান বগুড়ার শিল্পোদ্যোক্তারা
বগুড়ার শিল্পোদ্যোক্তা এবং ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ জেলার মানুষ বরারবরই উৎপাদনমুখী। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে বস্ত্র, লৌহ, সাবান, কাঁচ, সিরামিক, দিয়াশলাই এবং ট্যোবাকো খাতে অর্ধশত কল কারখানা গড়ে তোলার মাধ্যমে স্থানীয় উদ্যোক্তারা তার প্রমাণও দিয়েছেন। এ কারণে ১৯৬০ সালে এ জেলায় বিসিক শিল্পনগরী গড়ে ওঠার আগেই বগুড়া ‘শিল্পের শহর’ হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পায়। পরবর্তীতে শহরের ফুলবাড়ি এলাকায় প্রথমে ১৪.৫০ একর জায়গার ওপর বিসিক শিল্পনগরী গড়ে তোলা হয়। ব্যাপক চাহিদার কারণে ১৯৮০ সালে শিল্পনগরী আরও ১৮ দশমিক ৬৭ একর সম্প্রসারণ করা হয়। কিন্তু বর্ধিত শিল্পনগরীর প্লটগুলোও দ্রæত কল-কারখানায় পরিপূর্ণ হয়ে যায়। মূলত তার পর থেকেই স্থানীয় উদ্যোক্তরা শিল্প স্থাপনের জন্য জায়গা চেয়ে বিসিকের কাছে ধর্ণা দিতে শুরু করেন। কিন্তু সরকার তাতে কর্ণপাত না করায় স্থানীয় উদ্যোক্তারা বাধ্য হয়েই ফসলি জমিতে শিল্প কলকারখানা স্থাপন শুরু করেন। এতে একদিকে যেমন ফসলি জমি কমতে থাকে তেমনি পরিবেশ দূষণও বেড়ে যায়। ফলে বিসিক কর্তৃপক্ষ ২০১৪ সালে দ্বিতীয় শিল্পনগরী স্থাপনে নতুন করে উদ্যোগ নেয়। কিন্তু সেটিও মুখ থুবড়ে পড়ে। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে বগুড়ায় শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দক্ষিণে শাজাহানপুর উপজেলার গোহাইল ইউনিয়নের খাদাশ ও শালিখা মৌজায় ৩০০ একর জমিতে ‘উত্তরাঞ্চল কৃষিজাত পণ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প পার্ক’ স্থাপনের প্রকল্প নেওয়া হয়। সেখানে মোট ৬৪০টি প্লট নির্মাণের জন্য জমি অধিগ্রহণসহ মোট ব্যয় ধরা হয় ৯২০ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। তবে সেটি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হলেও রাজনৈতিক কারণে আটকে রাখা হয়। বিসিকের দায়িত্বশীল এক শীর্ষ কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, গত সরকারের শাসনামলে বগুড়ার নাম শুনলেই নীতিনির্ধারকরা চরম অসন্তুষ্ট হতেন। আর সে কারণে প্রকল্পগুলো চুড়ান্ত অনুমোদনের জন্য একনেকে নেওয়া সম্ভব হতো না। 

 


তবে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বগুড়ায় বিসিকের শিল্প পার্ক স্থাপন প্রকল্পটি নিয়ে নতুন করে তোড়জোড় শুরু হয়েছে। বিসিকের নবনিযুক্ত পরিচালক মীর শাহে আলম জানান, প্রকল্পটি নতুন করে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হচ্ছে। প্রতিবেদন পেলেই দ্রæত সময়ের মধ্যে অনুমোদনের উদ্যোগ নেওয়া হবে। বাংলাদেশ এগ্রিকালচারাল মেশিনারী মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (বামমা) বগুড়া জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক রাজেদুর রহমান রাজু আক্ষেপ করে বলেন, দেশে এমনও অনেক বিসিক শিল্পনগরী আছে যেখানে প্লট ফাঁকা পড়ে আছে। কিন্তু বগুড়ার চিত্র সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে শিল্প স্থাপনের জন্য উদ্যোক্তারা জায়গা পাচ্ছেন না। আমরা জায়গার জন্য অনেক কাকুতি-মিনতি করেছি। কিন্তু আমাদের ন্যায্য দাবিগুলো কোন দিনই আমলে নেওয়া হয়নি। শুধু প্রকল্পের নামে মূলা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। তবে উত্তরাঞ্চলের অনেক জায়গায় বিসিকের দ্বিতীয় শিল্পনগরী এবং শিল্প পার্ক করা হলেও বগুড়াকে উপেক্ষিত রাখা হয়েছে। আশাকরি অতীতের সেই বৈষম্যমূলক কর্মকান্ড থেকে বর্তমান সরকার বেড়িয়ে আসবে এবং বগুড়ায় খুব দ্রæত একটি শিল্প পার্ক স্থাপনে উদ্যোগ গ্রহণ করবে।

 


বিসিক বগুড়া জেলা কার্যালয়ের উপ-মহাব্যবস্থাপক একেএম মাহফুজুর রহমান জানান, প্রস্তাবিত শিল্প পার্ক নিয়ে নতুন করে কাজ শুরু হয়েছে। আশাকরি এবার এ অঞ্চলের শিল্পোদ্যোক্তাদের দাবি বাস্তবায়ন হবে। তিনি বলেন, ‘যে প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছে সেটি বাস্তবায়িত হলে বগুড়াসহ এই অঞ্চলের লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।’