বগুড়ায় সাত মাসে ১৯টি হত্যাকাণ্ডের ৭০ শতাংশই ধারালো অস্ত্রে
অরুপ রতন
জানুয়ারি থেকে জুলাই—মাত্র সাত মাসেই বগুড়ায় ১৯ জন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে অন্তত ১৩ জনকে হত্যা করা হয়েছে ধারালো অস্ত্র দিয়ে—ছুরিকাঘাত, রামদা ও দা দিয়ে কুপিয়ে অথবা গলা কেটে। যা মোট খুনের ৭০ শতাংশ। এমন পরিস্থিতিতে জেলায় বাড়ছে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ, আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
জেলা পুলিশের তথ্য বিশ্লেষণে উঠে আসে, এই সাত মাসে মোট ১৬টি ঘটনায় ১৯ জন নিহত এবং আহত হয়েছেন পুলিশ সদস্যসহ অন্তত ৮ জন। এসব ঘটনার অন্তত ১৩টিতেই প্রত্যক্ষভাবে ছুরি, রামদা বা অন্য কোনো ধারালো অস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে। শতকরা হিসেবে যা প্রায় ৭০ শতাংশ। এর বাইরে কয়েকটি ঘটনায় শ্বাসরোধ ও ভারী ধাতব বস্তু ব্যবহার করে হত্যার তথ্য রয়েছে।
নৃশংসতা ও অনিয়ন্ত্রিত সহিংসতার মাত্রা বাড়তে শুরু করে মার্চ থেকে। ওই মাসেই চারটি ঘটনায় পাঁচজন খুন হন, যার মধ্যে কিশোর গ্যাং দ্বন্দ্বে এবং পারিবারিক সহিংসতায় একাধিক ছুরিকাঘাতের ঘটনা ঘটে। সাবগ্রামে দ্বিতীয় স্বামীর রামদার কোপে মারা যান দুই নারী—ছকিনা বেগম ও আনোয়ারা বেগম। একই মাসে গাবতলীতে ১৩ বছরের এক শিশুকে গলা টিপে হত্যা করা হয়, এবং শেরপুরে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে আকবর আলীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
জুনে ছুরিকাঘাতে প্রাণ হারান তিনজন, আহত হন পাঁচজন। ১৩ জুন শহরের কাটনারপাড়ায় মাদকের ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে বন্ধুর ছুরিতে খুন হন বিদ্যুৎ শেখ। একই দিনে সারিয়াকান্দিতে কিশোর গ্যাংয়ের ছুরিকাঘাতে গার্মেন্টস কর্মীসহ আহত হন তিনজন। ২৬ জুন শাজাহানপুরে পূর্বপরিকল্পিতভাবে ছুরিকাঘাতে খুন হন আনোয়ার হোসাইন।
সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটে জুলাইয়ে। প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় বগুড়া শহরের ইসলামপুরে দাদিশাশুড়ি লাইলী বেওয়া ও নাতবউ হাবিবা ইয়াসমিনকে গলা কেটে হত্যা করে সৈকত হাসান নামের এক যুবক। বাঁচতে গিয়ে সৈকতের ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত হন বন্যা নামের এক কিশোরী। এই ঘটনায় গোটা শহর কেঁপে ওঠে। একই মাসে দুপচাঁচিয়ার লক্ষ্মীমণ্ডপ গ্রামে শ্বশুর আফতাব হোসেন ও পুত্রবধূ রিভা খাতুনকে শ্বাসরোধে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ঘটনাস্থল থেকে তছনছ ঘর ও হাত-পা বাঁধা মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
মোট হিসাব অনুযায়ী, জানুয়ারিতে ২ জন, ফেব্রুয়ারিতে ২ জন, মার্চে ৫ জন, জুনে ৬ জন এবং জুলাইতে ৪ জন খুন হন। এপ্রিল ও মে মাসে বগুড়ায় উল্লেখযোগ্য কোনো হত্যাকাণ্ডের তথ্য পাওয়া যায়নি।
পরিসংখ্যান বলছে, অধিকাংশ হত্যাকাণ্ড রাতে সংঘটিত হয়েছে এবং অপরাধীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভিকটিমের পূর্বপরিচিত। মাদক, কিশোর গ্যাং, পারিবারিক দ্বন্দ্ব ও প্রেম সংক্রান্ত কারণে এসব হত্যাকাণ্ড বেশি ঘটছে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। বিশেষ করে কিশোর গ্যাং নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে দুশ্চিন্তা তীব্র আকার ধারণ করেছে।
নিহতদের স্বজনদের দাবি, অধিকাংশ ঘটনার পরপরই মূল আসামি গ্রেপ্তার হলেও বিচারপ্রক্রিয়ার ধীরগতির কারণে অপরাধীরা বারবার সাহস পায়। তারা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের দাবি জানান।
বগুড়াবাসী বলছেন, হত্যা যেন এখন হালকা অপরাধে পরিণত হয়েছে। ছুরি-রামদা নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে তরুণরা। প্রতিটি ঘটনায় চাঞ্চল্য তৈরি হলেও কিছুদিন পর চাপা পড়ে যাচ্ছে। বিচার হচ্ছে না, শাস্তি মিলছে না।
পুলিশের তৎপরতা বাড়ানোর পাশাপাশি বিচারপ্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা, সামাজিক সচেতনতা, পারিবারিক শিক্ষা, কিশোর অপরাধ দমন এবং তরুণদের মাদক থেকে দূরে রাখতে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলছেন তারা।
সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযান (সুপ্র) বগুড়া জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক কেজিএম ফারুক বলেন, ‘বগুড়ায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। ধারালো অস্ত্র বেচাকেনা রোধে প্রশাসনের তদারকি দরকার। পুলিশের সাড়াশি অভিযানের অভাবে অপরাধীরা বারবার সুযোগ পাচ্ছেন। আর যদি দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচার সম্পন্ন করা যায়, অনেকাংশেই অপরাধ কমে যাবে।’
বগুড়া জেলা পুলিশ সুপার জেদান আল মুসা বলেন, ‘ধারালো অস্ত্রের ব্যবহার রোধে পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সমাজকে আগে এগিয়ে আসতে হবে। আমরা পুলিশের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে লিফলেট বিতরণ শুরু করেছি। নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে এবং অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। তবে সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টাতেই সব ধরণের অপরাধ কমিয়ে আনা সম্ভব। আমরা বিশ্বাস করি, বগুড়াবাসী এক্ষেত্রে ব্যাপক সজাগ ভূমিকা পালন করবে।’