আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল : আমাদের বিভাজন কেন কিভাবে

জোবায়ের হাসান :
প্রকাশ: ১১ জুন ২০১৮ ১১:০২ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ১১১২ বার।

আমাদের দেশে ফুটবল খেলার জনপ্রিয়তা কি পরিমাণ আকাশ ছোঁয়া ছিলো তা বোঝার জন্য একটি বাক্যই যথেষ্ঠ। বলা হতো এমন কোনো বাঙালি পুরুষ নেই যিনি শৈশব- কৈশোরে অথবা যৌবনে ফুটবলে লাথি মারেন নি। খড়-কুটো, নাড়িকেলের ছাল- এমন যা কিছুই হাতের কাছে পেয়েছে তাই চট, সুতলি দিয়ে গোলাকার বল বানিয়েছে এবং তাতে লাথি দিয়েছে। রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে শস্যের ক্ষেত যখনই ফাঁকা হয়েছে তখনই ফুটবল খেলেছে। সামান্য পাড়া ভিত্তিক খেলাতেও দর্শক হাঙ্গামা হয়েছে। পরাজয় খেলার অংশ বাঙালি এটা মানতে চায় না। এজন্যই বোধহয় ল্যাটিন দেশের আগে আমাদের দেশে এই খেলার প্রচলন হলেও আমরা কোনা সাফল্যই দেখাতে পারিনি। সাবেক বৃটিশ উপনিবেশ হিসাবে আমাদের ভালো ফুটবল খেলার কথা। কিন্তু উন্নতমানের ফুটবল খেলা তো দূরের কথা, ফুটবল খেলাটাকেই আমরা যেনো যাদুঘরে পাঠিয়েছি। এখন আমরা গ্রাম বাংলার পাড়ায় ফুটবল খেলি না, শহর-উপশহরেও তা খেলি না। আমরা এখন শুধুমাত্র টিভি সেটের দর্শক ও সমর্থক হয়েছি, আর কেউ কেউ ফুটবল বোদ্ধা হবার ভান করছি। আমাদের দেশে এক সময়কার তুমুল জনপ্রিয় ও আমোদিত এই ফুটবল খেলার বর্তমান দৈন দশা মনকে ব্যাথাতুর করে তোলে। হারানো স্মৃতিগুলো মনকে মমের মত করে জ্বালিয়ে যায়।

শৈশব-কৈশোর ও যৌবনে খেলেছি এবং খেলা দেখেছি। খেলার গল্প বাদ দিয়ে খেলা দেখার গল্প বলতে বসেছি। কারণ এটা রাশিয়া বিশ্বকাপের মাস। প্রসঙ্গ আর্জেন্টিা-ব্রাজিল এবং আমাদের বিভাজন। হ্যাঁ, আমি আমাদের দেশে সর্বাধিক জনপ্রিয় দুটো দেশের প্রতি গণমানুষের সমর্থন ও সেটার প্রেক্ষাপটের বিশেষ একটা দিক নিয়ে লিখতে বসেছি। সেটা হলো- কেন এবং কেখন থেকে আমাদের দেশে ফুটবল পাগল জাতি আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল সমর্থক গোষ্ঠী হিসেবে বিভাজিত হয়েছে?

ব্রাজিলের ’৭০ সালে বিশ্বকাপ জয় এবং সেটার নায়ক রাজ পেলের খেলা দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। ’৮২ সালে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় সাদাকালো টিভি সেটের সামনে অল্প বিস্তর খেলা দেখা। তবে খেলা দেখার চেয়ে বাবা এবং চাচাদের ফুটবল বিষয়ক গল্প শোনাতেই বেশি আকর্ষিত হতাম। তখন টিভি সেট দুর্লভ থাকায় সেটার সামনে উপচে পড়া দর্শকম-লীর ভিড়। বাবা-চাচাদের মতো শিক্ষিত উর্ধ্বতন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্বের মুখ থেকে নিঃসৃত হচ্ছে শুধু ব্রাজিল বন্দনা ও পেলের গুণকীর্তন। ’৭০ সালের স্মৃতি তাঁদেরকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। তাঁদের পছন্দের দল ব্রাজিল। ব্রাজিল ছন্দময় ফুটবল খেলে। রাস ফুটবল খেলে না, রাফ ট্যাকেলও করে না। ব্রাজিলের খেলোয়াড়রা শুধু মাঠে খেলেই না বরং শিল্পীর তুলিতে ছবি আঁকে মাঠজুড়ে। যেটার পেছনে থাকে দর্শকদের আবহ সঙ্গীত ও সাম্বার নৃত্য। গুরুজনদের এমন প্রশংসা বাণীর বিপরীতে কোনো প্রতিবাদ-বাদানুবাদ নেই। বারান্দা ও আঙিনা ভর্তি দর্শকরা সবাই বলছেন কাপ যেনো ব্রাজিলের ঘরে আসে। আর তা না হলে অন্তত যেনো ল্যাটিনদের ঘরে থাকে। লক্ষ্য করলাম, ইউরোপ বিরোধিতায় সবাই যেনো একমত। 

আজকের মতো ব্রাজিল বনাম আর্জেন্টিনার বিভেদ দর্শক সারিতে ছিলো না বরং তা ছিলো ল্যাটিন বনাম ইউরোপ। তবে ল্যাটিনের পক্ষে ঐক্যমত এতটাই প্রচণ্ড ছিলো যে, তাদের সমর্থনের ভিড়ে ইউরোপীয় কোনো দেশের সমর্থকদের খুঁজেই পাওয়া যেতো না। সম্ভবত এর একটা রাজনৈতিক কারণও ছিলো। ইউরোপীয়রা (ইংরেজরা) ভারতীয় উপমহাদেশকে শাসন ও শোষণ করেছে, আবার তারা (যেমন স্প্যানিশরা আর্জেন্টিনা, পর্তুগীজরা ব্রালিজকে) ল্যাটিন মহাদেশকেও শাসন-শোষণ করেছে। এ কারণেই এক প্রান্তের নির্যাতিতরা অপর প্রান্তের শোষিতদের সমর্থন করতে চেয়েছে। সে জন্যই বোধকরি তখন পর্যন্ত আর্জেন্টাইন ও ব্রাজিলীয় সমর্থক গোষ্ঠী আলাদাভাবে সৃষ্টি হয়নি, তাই বৈরিতারও প্রশ্ন আসেনি। এর অন্যতম বড় প্রমাণ ’৮২-তে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ ইতিহাসে দ্বিতীয়বারের মত মুখোমুখি হয়েছিল এবং আর্জেন্টিনা ৩-১ গোলে পরাজিত হয়েছিলো। টিভি সেটের সামনে বসে থাকা দর্শকরা আজকের মতো উল্লসিত বা বেদনাহত হয়নি। নিছক খেলা হিসাবেই দেখেছে। এমনকি ম্যারাডোনা অসংখ্য ফাউলের শিকার হয়ে, শেষে মেজাজ হারিয়ে ব্রাজিলীয় খেলোয়াড়কে লাথি মেরে অনেকটা স্বেচ্ছায় লালকার্ড খেয়ে মাঠ থেকে বহিস্কৃত হয়েছিলেন। এই ঘটনারও তীব্র প্রতিক্রিয়া দর্শকদের মধ্যে দেখা যায়নি। তারা খেলাটাকে নিছক খেলা হিসাবেই দেখেছে। বাংলাদেশের তখনকার প্রায় শতভাগ ব্রাজিলীয় সমর্থকদের চোখে ম্যারাডোনা তখনও ভিলেন হননি। কারণ ম্যারাডোনা তখনও পর্যন্ত বিশ্বজয়ী হিরোতে পরিণত হননি। অবশ্য প্রতিবেশী দেশ দু’টির জনগণের বৈরিতা ভিন্ন কথা। ধর্মে এক হলেও ভাষাগত পার্থক্য বিদ্যমান। ব্রাজিলীয়রা পর্তুগীজ আর আর্জেন্টাইনরা স্প্যানিশ। পরস্পরের প্রতি খেলা ও রাজনীতি নিয়ে বৈরিতা থাকাটাই স্বাভাবিক। 

তবে তখন পর্যন্ত সেই বৈরিতার ঢেউ বাংলাদেশের জনগণের ওপর আছড়ে পড়েনি। এর বিপরীতে বরং বাবা-চাচাদের আলোচনায় দেখেছি ব্রাজিলের সমর্থক হয়েও তারা হারিয়ে যাওয়া ‘চে গুয়েভার’-কে বার বার খুঁজে ফিরছিলেন আর্জেন্টাইনদের মাঝে। ’৮২-র বিশ্বকাপ শুরুর কিছু পূর্বেই ঘটে যায় ফকল্যান্ড দ্বীপের মালিকানা নিয়ে আর্জেন্টিনা-ইংল্যান্ডের যুদ্ধ। অসম সামরিক শক্তির সেই লড়াইয়ে আর্জেন্টিনা দুর্বল হয়েও স্বল্প সংক্ষিপ্ত সময়ের লড়াইয়ে সাহসিকতার সাথে বীরের মতো যুদ্ধ করে। ’৮২-র বিশ্বকাপকে ঘিরে গুরুজনদের মুখে সেই আর্জেন্টাইনদের বীরত্বের কথা শুনছিলাম বার বার। উপস্থিত দর্শকরা সবাই যেনো ইংরেজ তথা ইউরোপ বিরোধী। সাবেক ঔপনিবেশিক শাসকদের প্রতি ক্ষোভটা বেশ তীব্রই ছিলো। যা হোক তখনকার অবস্থা এরূপ ছিল যে, ‘আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলে ভাই ভাই, ইউরোপীদের রক্ত চাই’। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাপ জিতলো ইতালি। যার নায়ক ছিলেন পাওলো রসি।

এলো ’৮৬-র বিশ্বকাপ। টিভি ও প্রিন্ট মিডিয়ার প্রসার চার বছর আগের চেয়ে কিছুটা বেড়েছে। সংবাদ, ইত্তেফাক, ইনকিলাব, সাপ্তাহিক যায়যায়দিন, বর্তমান দিনকাল, রোববার-এক প্রকার শোরগোল পড়ে গেলো এবার ব্রাজিল বিশ্বকাপ জিতবেই। ভবিষ্যত বাণী, ল্যাটিন দেশ মেক্সিকোতে বিশ্বকাপের আয়োজন, তারকা খেলোয়াড়দের বিগত দিনের নৈপুণ্যের চুলচেরা বিশ্লেষণ- সবটাতেই ব্রাজিল এগিয়ে। পেলে-টেলের সন্তানরা বলছেন ব্রাজিলই হবে চ্যাম্পিয়ন। ব্রাজিলের সামনে ফ্রান্স। কোয়ার্টার ফাইনালের ম্যাচ, জয়ী দল যাবে সেমিফাইনালে। সেই ম্যাচে ব্রাজিলের সক্রেটিস, জিকো, ফ্যালকাও, জুলিও সিজার, এ্যালমাও মাঠ দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। আর অন্যদিকে ফ্রান্সের টিগানা, প্লাতিনিরা প্রতি আক্রমণ করেছেন। ব্রাজিল গোল করে এগিয়ে যায়, মুহূর্তেই ফ্রান্স সমতা আনে। অতিরিক্ত সময়ে ব্রাজিলের পেনাল্টি লাভ করে কিন্তু জিকো তা মিস করে হিরো থেকে জিরো হয়ে গেলেন। অবশেষে টাইব্রেকারে ফ্রান্সের জয়। দুঃখের সাগরে ভাসলো দেশ। এই ম্যাচটাকেই বলা হয় শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ম্যাচ। এই স্বীকৃতিটা বিশ্বজনীন, বিতর্কহীন। তখন পর্যন্ত আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল সমর্থক গোষ্ঠী আলাদাভাবে তৈরি হয়নি। এরপর সবাই প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ভর করেছি আর্জেন্টিনার ওপর। আমাদের প্রত্যেকের চাওয়া তখন হয়ে গেলো ল্যাটিন দেশ আর্জেন্টিনা। ইউরোপের ফ্রান্স বা জার্মানিকে হারানো। বিশেষ করে বদমায়েশ ফ্রান্সকে হারালে খুব মজা হবে। এরপর টিভি পর্দায় চোখ মেলে আমরা যা দেখলাম তা ল্যাটিন ফুটবলের শৈল্পিক সৌন্দর্য্যরে চরম বিকাশ এবং ব্যক্তিগত একক নৈপুণ্যের প্রদর্শন। সেটার নাম ছিলো আর্জেন্টিনা ও ম্যারাডোনা। আমার বাবা-চাচারা ম্যারাডোনার মাঝেই বুঝি খুঁজে পেলেন বিপ্লবী ‘চে গুয়েভার’-কে। 

ব্যক্তিগত একক নৈপুণ্যে বেলজিয়াম ও ইংল্যান্ডকে পরাজিত করে ফাইনালে ম্যারাডোনা। ঐ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৫/৬জন খেলোয়াড়কে বোকা বানিয়ে শতাব্দীর সেরা গোল করা আবার সেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষেই ঈশ্বরের হাত দিয়ে গোল করে বিশ্ব সেরা গোল রক্ষক পিটার শিল্টনকে পরাস্ত করার মাধ্যমে ফুটবলের কিংবদন্তী বনে গেলেন ম্যারাডোনা। অতঃপর ফাইনালে তার সতীর্থ বুরুচাগা, ভালদ্যানো, গুয়িস্তি, বাতিস্তারা যাদুকরী ফুটবল খেলে কাপ ইউরোপের হাত থেকে ল্যাটিন মহাদেশে ছিনিয়ে আনলো। এই ফুটবল যাদুকর ম্যারাডোনা সম্পর্কে বলা যায়-আজকের দিনের মতো বিপক্ষের খেলোয়াড়দের পেছন থেকে জার্সি-শর্টস টেনে ধরা অথবা সাইড ট্যাকেল-ব্যাক ট্যাকেলের মতো নিষিদ্ধ আইনগুলো যদি ম্যারাডোনার সময় থাকতো, তবে তার পায়ের যাদুতে নিঃসন্দেহে আরো অধিকবার দর্শক বিমোহিত হতো। যা হোক বিশ্বকাপ জয়ী ফুটবল যাদুকর ম্যারাডোনা বিশ্বময় নন্দিত হতে থাকলেন। বিশেষ করে আমাদের বাংলাদেশে তিনি যেনো রূপকথার নায়কে পরিণত হলেন। হাটে-বাজারে, শহর-গ্রামে, বাসে-ট্রেনে, ক্ষেত-খামারে, অফিস-আদালতে সর্বত্র একই আলোচনা ম্যারাডোনা; প্রিয় ম্যারাডোনা। বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামকরণ শুরু হলো ম্যারাডোনার নামে। শ্রমিকরা কাজে বেরুলেন ম্যারাডোনার প্রতিকৃতি সম্বলিত টি-শার্ট পরে। কৃষক যখন ধান কাট তখন তার বুকেও ম্যারাডোনার ছবি। স্থানীয় মাঠে গ্যাট্টা-গুট্টা-বেঁটে জাতীয় বাঁ পায়ের কোনা ফুটবলার বল নিয়ে কিছুটা ড্রিবলিং করলেই দর্শকরা হর্ষধ্বনি দেয় এবং শ্লোগান তোলে ম্যারাডোনা-ম্যারাডোনা! ঠিক যেমনটা হয়েছিলো ইরাকের সাদ্দামের বেলায়-‘বাপের ব্যাটা সাদ্দাম’ সম্বোধন করে প্রশংসা করা। অবশ্য সাদ্দাম হোসেনের ঘটনাটা ’৯০ সালের আর ম্যারাডোনা হিরো বনে যাওয়াটা ’৮৬ সালের। তুলনা করার জন্য বললাম আরকি! শিক্ষাঙ্গণে ম্যারাডোনার খ্যাতি-ভক্তি যতটা দেখেছি সেটার চেয়ে সহস্রগুণ বেশি দেখেছি কৃষক, শ্রমিক ও সাধারণ জনগণের মাঝে।

এরপর ইটালিয়া বিশ্বকাপ ১৯৯০। প্রথম ম্যাচেই ক্যামেরুন দানবের তাণ্ডবে উড়ে গেলো আর্জেন্টিনা। পাওয়ার ফুটবলের কাছে পরাজিত হলো স্কিল। এলোমেলো ফুটবল খেলে ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’-র মতো কাঁচুমাচু করে কোন মতে মাঠ ছাড়লো আর্জেন্টিনা। বিজয়ী অদম্য সিংহের দলের নেতৃত্ব দিলেন ‘রজার মিলা’। ক্যামেরুন দলটি কোয়র্টাার ফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছালো এবং ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে সিংহের মতো লড়াই করে পরাজিত হলো। আর আর্জেন্টিনার খেলায় দর্শক হলো হতাশ এবং এই নড়বড়ে দলটাকে নিয়ে বিশ্বকাপ জয়ের আশা প্রায় ত্যাগই করলো। সমর্থন ও ভরসা থাকলো মহাদেশের ব্রাজিলের ওপর। তবুও কোনোক্রমে ঠেলেঠুলে এই ভাঙ্গাচোড়া দলটি গিয়ে পৌঁছালো দ্বিতীয় রাউন্ডে। কিন্তু ওরে বাপরে বাপ! খেলা যে পড়ে গেলা ব্রাজিলের সাথে। ব্রাজিল এবারের বিশ্বকাপেও হট ফেবারিট। কাপটা যে এবার তাদের চাই-ই চাই। তা না হলে বিশ্বসেরার তকমাটা যে আর থাকে না। প্রতিবার একটা না একটা ট্রাজেডির মধ্য দিয়ে শেষ হয়ে যায় কাপ জয়ের সাধ। এবার তারা অতি সতর্ক এবং কোনো প্রকার কুফ-টুফার ধার ধাওে না। ’৮৬’র জয়ী দলকে সমর্থন করা নিয়ে বাংলাদেশের সমর্থকরা পড়ে গেলো দোটানায়,সম্ভবত কোনো এক পত্রিকায় এটা নিয়ে সে সময় রিপোর্ট হলো- বাংলাদেশের ফুটবল প্রেমীরা কোন দলকে সমর্থন করবে সেটা নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ও দোদুল্যমান। এই অবস্থায় অনেকটা মৌন সমর্থকের মতো বসে পড়লাম আমরা টিভি সেটের সামনে। প্রত্যাশা এই যে, আর্জেন্টিনা হারলেও অসুবিধা নেই, ব্রাজিল থাকবে, ল্যাটিন ফুটবল থাকবে। তাছাড়া গতবার তো আর্জেন্টিনাই কাপ জিতেছে, এবার ব্রাজিল জিতলে সমস্যা নাই। 

খেলা শুরু হলো। ব্রাজিলের মুহুর্মুহু আক্রমণে আর্জেন্টিনার যায় যায় অবস্থা। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধের একেবারে শেষ দিকে খেলার গতিধারার বিপরীতে আর্জেন্টিনা গোল করে বসে। সারা খেলায় কড়া মার্কিং-এ থাকায় নিষ্ক্রিয় হয়ে পরা ম্যারাডোনা হঠাৎ মাঝ মাঠের কাছাকাছি জায়গায় বল পেয়ে যান। অতঃপর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে একাই বল নিয়ে এগিয়ে  গিয়ে আগন্ত ক্যানিজিয়ার  প্রতি রসগোল্লা বানিয়ে দেন। ক্যানিজিয়া এই রসগোল্লাকে অতি সহজেই ব্রজিলের জালে জড়িয়ে দেন। টিভি ধারাভাষ্যকার দীর্ঘশ্বাস ধরে রেখে ক্যানিজিয়ার নাম উচ্চারণ করেন এবং আমাদের ৫০-৬০জন সদস্যের মধ্য থেকে মাত্র একজন উন্নত নাসিকা ও গৌড় বর্ণের অধিকারী জার্মান সমর্থক বন্ধু চিৎকার করে উল্লাসে ফেটে পড়েন। আর সব ব্রাজিলীয় সমর্থকরা বেদনায় মুষড়ে পড়লো। আর্জেন্টিনার সমর্থকদের উল্লাস-উপস্থিতি তখনও টের পাওয়া যায়নি। তবে আমাদের অনেকেই ভাবলাম যাক ক্ষতি কি? ভাইয়ের কাছে ভাই হেরেছে, ল্যাটিন তো রয়েছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে টের পেলাম কট্টর ব্রাজিলীয় সমর্থকরা তাদের সাম্রাজ্যে অন্য যে কেউ ঢিল মারুক এটা যেমন সহ্য করতে পারেনি, তেমনি ফুটবল জগতে আর্জেন্টিনার মতো আরেকটি পরাশক্তি উঠে আসু সেটাও চায়নি। তারা চেয়েছে বাংলাদেশ ব্রাজলীয় সমর্থনের এক চেটিয়া ও আধিপত্যবাদী ধারা বজায় থাক। তাদের এই মানসিক চিন্তাধারার বাহিঃপ্রকাশ ঘটলো পরের ম্যাচগুলোতে। আমাদের পূর্বেও ম্লোগান ছিলো ‘ল্যাটিন-ল্যাটিন ভাই ভাই, ইউরোপয়দের পরাজয় চাই’। 

সেই হিসাবে আর্জেন্টিনার পরবর্তী ম্যাচগুলোর সবই হবে ইউরোপীয় দেশগুলোর বিপক্ষে। আর্জেন্টিনার পরবর্তী ম্যাচ যুগোশ্লাভায়িার সাথে। এই ম্যাচে সকল ব্রাজিলীয় সমর্থকরা হঠাৎ করে যুগোশ্লাভাকিয়াকে জোরের সাথে সমর্থন দিতে লাগলো। আর্জেন্টিনা বিশ্রি রকমের বাজে খেলে ট্রাইব্রেকারে সৌভাগ্যের জয় পেলো। পরবর্তী ম্যাচ সেমিফাইনাল ইটালির বিরুদ্ধে। ভাবলাম আর্জেন্টিনা এমন জঘন্য খেলছে তাতে সমর্থন না পাওয়ারই কথা। তবে ইটালির সাথে সেমিফাইনালে এসে আর্জেন্টিনা যেনো ’৮৬-র মতো ভালো খেলতে লাগলো। কিন্তু এবারও দেখা গেলো ব্রাজিলীয় সমর্থকরা ইটালীকেই সমর্থন করছে। এই ম্যাচেও আর্জেন্টিনা টাইব্রেকারে স্বাগতিক ইটালীকে হারিয়ে ফাইনালে পশ্চিম জার্মানির মুখোমুখি হয়। আর্জেন্টিনা চায় খেলা যেনো টাইব্রেকারে গড়ায়। কেননা তাদের সাইড লাইনের অতিরিক্ত গোলকিপার ততোদিনে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। তাঁর নাম ছিলো গায়কোচিয়া। পেনাল্টি শট ঠেকানোর মন্ত্র জানা যাদুকর। কিন্তু ইটালীয় রেফারির বিতর্কিত ভূমিকার কারণে আর্জেন্টিনা পরাজিত হয়। পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে রানার আপ দল আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়দের গলায় যখন  মেডেল পড়ানো হয়, তখন বিশ্বজয়ী নন্দিত তারকা দিয়েগো আর্মান্দো ম্যারাডোনা ছোট্ট শিশুর মতো অঝোর ধারায় কাঁদছিলেন। সেই কান্নার ঢেউ লাগে বাংলার কৃষক-শ্রমিকসহ সর্ব সাধারণের মাঝে। তারা তাদের নয়নের মধ্যমণির অপমান দুঃখে স্থির থাকতে পারেনি। তারাও কেঁদেছে, বিক্ষুব্ধ হয়েছে, প্রতিবাদ করেছে। যত দূর মনে পড়ে বিবিসি বাংলা বিভাগের খবর অনুযায়ী কলকাতাতেও তাই হয়েছে। আর আমি যে দেশ সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হল রুমে বসে খেলা দেখছিলাম সেখানে দেখলাম ৫০-৬০জনের মধ্যে মাত্র তিনজন কাঁদছেন। বাকিরা বেশ মজা করে জার্মানদের কাপ নেওয়া উপভোগ করছে। ল্যাটিন-ল্যাটিন ভাই ভাই, ইউরোপীয়দের পরাজয় চাই শ্লোগানটা বুঝি আর থাকলো না। বাংলাদেশে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার বিভাজনটা এখান থেকেই মূলত শুরু। যদিও তা স্থায়ী রূপ লাভ করতে আরও দু’টো বিশ্বকাপ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে।

১৯৯০-এর বিশ্বকাপ পরবর্তী সময়ে ইটালিতে ম্যারাডোনার খেলোয়াড়ি জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। ইটালীর মাফিয়া ডন এবং সংবাদপত্র ম্যারাডোনার পিছু নেয়। প্রিয় দল নেপোলির হয়ে পুনরায় খেলতে নেমে ইটালীয় দর্শকদের কাছে ম্যারাডোনাকে যথেষ্ঠ রকমের হয়রানির স্বীকার হতে হয়। ফুটবল যাদুকরের ক্যারিয়ার রাজনৈতিক ম্যারপ্যাচে এক রকম নষ্ট হয়ে যায়। ম্যারাডোনাকে বিশ্বব্যাপী এক নিন্দিত চরিত্ররূপে দেখানোর চেষ্টা চলতে থাকে। তাঁর অপরাধ একটাই। সেটা হলো ইটালির মাটিতে স্বাগতিক ইটালিকে সেমিফাইনালে হারিয়ে দিয়ে বিশ্বকাপ জয়ে বঞ্চিত করা। পৃথিবীব্যাপী খেলা ভিত্তিক গড়ে ওঠা সমস্ত স্পোর্টস্ অর্গানাইজেশন ছবক দেয় ‘ফেয়ার প্লে’,‘পাতানো খেলা’  খেলা যাবে না, খেলার মধ্যে রাজনীতি আনা যাবে না, দর্শক-সমর্থক- খেলোয়াড়-ক্রীড়া সংগঠক কেউই বর্ণ-ধর্ম বিদ্বেষী শ্লোগান বা প্লাকার্ড বহন করতে পারবে না, এমনকি নীতিবাক্যের ছবক দেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে FIFA (ফিফা)। অথচ খোদ এই সংগঠনটিই খেলা নিয়ে রাজনীতি করে। দুর্নীতি করে টাকা কামায়, যা সম্প্রতি হাতে-নাতে ধরা পড়েছে। খেলাটা কখনোই রাজনীতির বাইরে থাকেনি। কোন দেশ স্বাগতিক হবে, আর কোন দেশ সেখানে খেলতে না যাওয়ার হুমকি দিবে ইত্যাদি সবই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এরপর ফিরে যাই ’৯৪-এর বিশ্বকাপের কথায়। এবার আরো জোরে-শোরে আলোচনায় আসলো ব্রাজিল। কাপটি USA-এর মাটিতে নিতেই হবে। এজন্য ল্যাটিনের ঐতিহ্যবাহী ছন্দময় ফুটবলকে পরিত্যাগ করলেও করতে হবে। দরকার কাপ, ভালো খেলা পরের ব্যাপার। ইটালি জার্মানরা ওটাতে সফল। খেলার স্টাইল বদলে ফেলায় ব্রাজিলীয় মিডিয়ায় তুমুল পক্ষ-বিপক্ষের বিতর্ক হলো। মাথার উপর খড়গ নিয়ে ব্রাজিল দল খেলতে গেলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। মিশন সফল। চাব্বিশ বছর পর কাপ ব্রাজিলের ঘরে ফিরে এসেছে। নতুন নায়ক দুঙ্গা, বেবোতা, রোমারিও। দেশে ফিরে বীরোচিত সংবর্ধনা। ছন্দময় খেললো না রাফ ফুটবল খেললো, পাওয়ার ফুটবল খেললো না টোটাল ফুটবল খেললো, ডিফেন্সিভ খেললো না অফেন্সিফ খেললো সে সব আলোচনা বাদ। ব্রাজিল কাপ জিতলো এটাই বড় কথা। 

অন্যদিকে ’৯৪-এর বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা ও বুড়ো ম্যারাডোনার অবস্থা হলো হৃদয় বিদাকর ও মর্মান্তিক। এমনিতেই বিশ্বকাপে এসেছে টেনেটুনে অস্ট্রেলিয়ার সাথে বাছাই পর্বের ‘প্লে অফ’ খেলে। এরপর ম্যারাডোনার যখন পড়ন্ত বেলা, যাকে বলে বনে দাঁত পড়া সিংহ। তবুও তিনি মাঠের খেলায় ধারে না কাটলে ভারে কাটলেন। তবে রুমানিয়ার সাথে বাঁচা-মরা খেলার আগে ডোপ টেস্টে উত্তীর্ণ হতে না পেরে নিষিদ্ধি হলেন। ঘোষণা দেওয়া হলো যে, ম্যারাডোনার মূত্র পরীক্ষায় এফিড্রিন নামক দ্রব্যের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। নিষিদ্ধ ম্যারাডোনা দর্শক সারিতে বসে কাঁদলেন আর তার দল আর্জেন্টিনা অসহায়ভাবে রুমানিয়ার কাছে হেরে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিলো। আর্জেন্টিনার পরাজয়ে ম্যারাডোনার সাথে সাথে তাঁর ভক্ত সমর্থকরাও আবারো কাঁদলেন। আর ব্রাজিলীয় সমর্থকরা স্বস্তি পেলেন এই ভেবে যে, যাক আপদটা চলে গেছে। এর বিপরীতে আর্জেন্টাইন ভক্ত সমর্থকরা মনে করলো ব্রাজিলের পেলে ও ফিফা সভাপতি হ্যাভেলাঞ্জ-এই শালা-দুলা ভাইয়ের কারসাজিতে ম্যারাডোনাকে আটকে দিয়েছে।

এবার আমি আমার সর্বশেষ পর্যবেক্ষণ ’৯৮-এর বিশ্বকাপের আলোচনায় আমি বেশ কৌতুহলী হয়ে অপেক্ষা করছিলাম এটাই দেখার জন্য যে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল সমর্থকদের বৈরিতা স্থায়ী রূপ লাভ করে কি’না অথবা আবার ’৮২, ’৮৬-এর মতো সবাই ল্যাটিন ভক্ত হয়ে যাবে কি’না? শুরু হলো ’৯৮-এর বিশ্বকাপ। ছাত্রত্ব জীবন শেষ করে আমি এখন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকুরিরত। এবারে প্রথম বুঝলাম আর্জেন্টিনার সমর্থক সংখ্যা বিপুলভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ। ছাত্রজীবনে তাঁর উল্টা জানতাম। হেড অফিস ও ফ্যাক্টরির শ্রমিক-কর্মকর্তা কর্মচারী মিলিয়ে এক বিপুল সংখ্যক আর্জেন্টাইন ভক্ত সমর্থক। ’৯৮-এর বিশ্বকাপ উপলক্ষ্যে এরা যেন নিজ দলের শিরোপা জেতার চেয়ে ব্রাজিলকে ঠেকাতে খুব বেশি উদগ্রীব। আমার রিপোর্টিং বস ছিলেন একজন সাবেক যুগ্ম সচিব। তিনি বললেন, ‘দেখ! আমি আগে থেকে ব্রাজিল ছিলাম, কিন্তু এবার আমার নাতিটার দিকে তাকিয়ে আর্জেন্টিনা হয়েছি।’ আমি উত্তর দিলাম ‘খুব ভালো হয়েছে স্যার!’ আর্জেন্টিনা-ইংল্যান্ডের অসাধারণ খেলায় আর্জেন্টিনা জিতলো কিন্তু হল্যান্ডের বিপক্ষে হেরে কোয়ার্টার ফাইনালে হেরে বিদায়। এতে করে ব্রাজিল সমর্থকরা প্রচণ্ড উল্লসিত হলো। আর্জেন্টাইন সমর্থকরা অপেক্ষায় থাকলো কিভাবে ব্রাজিলকে ঠেকানো যায়। তাদের সামনে চুড়ান্ত সুযোগ আসলো ফাইনাল খেলায়। সকল আর্জেন্টাইন ভক্তরা সমর্থন করলো ফ্রান্সকে। শিরোপা জিতলো ফ্রান্স, যার নায়ক হলেন জিনেদিন জিদান। আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল সমর্থকবৃন্দদের দুধের সাথ ঘোলে মেটাতে যেয়ে কেউ-ই শিরোপা পেলো না। সব দেখে শুনে এতদিনে বুঝলাম, আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল দ্বান্দ্বিক সমর্থন স্থায়ী রূপ লাভ করেছে। ল্যাটিন-ল্যাটিন ঐক্য তিরোহিত হয়েছে। এরপর ২০০২, ২০০৬, ২০১০, ২০১৪ মোট চারটি বিশ্বকাপ গত হয়েছে। 

সামনে ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপ। এখন এসে ভাবছি ‘কোন দলের সমর্থক সংখ্যা বেশি’-এই জরিপ দিয়ে কী লাভ আমাদের? জনগণের মন মগজে দানা বাঁধা দ্বি-দলীয় সমর্থনের চিন্তা ধারায় উন্মাদনার সাথে  উগ্রতা যুক্ত হয়েছে। সমর্থনের মধ্যে যখন উগ্রতা ঢুকে যায় তখন সে খেলাটাকে উপভোগ করতে পারে না। খেলার মধ্যে যে সৌন্দর্য রয়েছে সেটা  দেখা থেকে সে বঞ্চিত হয়। এর চেয়েও বড় কথা, জাতি তাঁর চিন্তা-বিবেচনার এই শক্তিটা হারিয়ে ফেলে যে, ‘যুগের পরিবর্তন হয়েছে, তৃতীয় কোনো দলও এদের চেয়ে ভালো খেলতে পারে’। আমাদের দেশের জনগণ ও কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে এই ভাবনার উদয় হওয়া দরকার। কিভাবে আমাদের ফুটবলের হারানো গৌরবকে ফিরিয়ে আনা যায়? ফুটবল এমন এক খেলা যা তরুণ সমাজকে মাদক দ্রব্যের ছোবল থেকে রক্ষা করতে পারে। আর তাঁর সাথে চরম পর্যায়ের উত্তেজনাকর বিনোদন তো থাকছেই।