ইরান বরাম মরক্কো: দুই ভাইয়ের জমজমাট লড়াই

জুবায়ের হাসান:
প্রকাশ: ১৫ জুন ২০১৮ ১৪:০০ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ৪০১ বার।

ইরান বা পারস্য; ভাষা পার্সি। আরবি ভাষায় ‘প’ উচ্চারিত না হওয়ায় এই ভাষার নাম হয়েছে ফার্সি। ফার্সি ভাষার কালজয়ী ইসলামী কবি শেখ সাদী (রহঃ)-এর দেশ, বাংলার নবাব সিরাজের পূর্ব পুরুষের দেশ, তৎকালীন মোগল সম্রাজ্ঞী (ভারত বর্ষের প্রথম ফার্স্ট লেডি) নূর জাহানের দেশ ইরান। ইরানের গুলাব বা গোলাপ বিশ্ব মানব-মানবীর কাছে প্রিয় একটি ফুল। প্রেম-ভালোবাসা, সৌন্দর্য্য-সৌহার্দ্যরে প্রতীক গোলাপকে ভারতীয় উপমহাদেশে ইরানীরা পরিচিত করে তোলে। এ অঞ্চলের মুসলমানদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হলো-‘বিভিন্ন ফুল দিয়ে তোড়া বানিয়ে সেটার উপর অশের মাঝখানে গোলাপ বসিয়ে দেয়। অতঃপর সেই তোড়া উপহার হিসেবে কাউকে প্রদান করে।’ এদেশের হিন্দু ভাইয়েরা পূজার ফুল হিসাবে কেন গোলাপ ব্যবহার করেন না- সেটার কারণ সম্পর্কে আমি অবগত নই।
ইরান সম্পর্কে ছোট বেলার আরো একটি একটি স্মৃতি মনে পড়ে যায়। গ্রামের ছেলে-মেয়েরা ইরানী পিরান (কাপড় বা জামা বিশেষ) গায়ে দিয়ে ঈদের আনন্দে শরীক হতো। রাশিয়া-২০১৮ বিশ্বকাপে জায়গা করে নিতে বাছাই পর্বের লড়াইয়ে ইরানই সর্বপ্রথম টিকিট নিশ্চিতকারী দেশ। কাস্পিয়ান সাগরের উপর দিয়ে উড়ে গিয়ে তারা রাশিয়ায় খেলতে গিয়েছে। ইরানের ফুটবল সম্পর্কে লিখতে গিয়ে মনে পড়ছে ’৮৭, ’৮৮ এবং ’৮৯-এর ঢাকা লীগে মোহামেডান দলের হয়ে খেলা ইরানী খেলোয়াড় নাসের হেজাজি, বোরহানজাদে ও নালজেগারদের কথা। এদের অন্তর্ভূক্তিতে ঢাকা মোহামেডান হয়ে উঠেছিল এশিয়ার ক্লাব কাপ চ্যাম্পিয়ানশিপ লড়াইয়ের শক্তিশালী দল। কলকাতার ইস্ট বেঙ্গল, মোহনবাগান-এর তুলনায় অনেক পেছনে ছিলো। ইরানী খেলোয়াড়দের সংস্পর্শে এসে মোহামেডানের সাব্বির হয়ে উয়েছিলেন আঁকাবাঁকা সর্পিল গতির ছন্দময় অথচ ক্ষিপ্র একজন খেলোয়াড়। আজকের দিনে বাংলাদেশের ফুটবলের দৈনদশা। তাই এসব জমে থাকা স্মৃতি আমার মনের মধ্যে রোদোনাত্মক দোলা দিয়ে যায়। আমি যথেষ্ট পরিমাণে আবেগী হয়ে পড়ি। থাক সেসব কথা।

‘ইসলামিক রিপাবলিক অব ইরান’ এই বিশ্বকাপে জান-প্রাণ উড়ার করে দিয়ে সুতীব্র কঠিন এক দেশ প্রেম নিয়ে ফুটবল খেলবে। ফুটবলে তাদের যতটা না শক্তি-সামর্থ্য সেটাকেও অতিক্রম করে বেশি কিছু প্রমাণ করতে চাইবে। যেমনটা মানুষ বিপদে পড়লে সামর্থ্যরে চেয়ে বেশি গতিতে দৌড়ায়। ইরানের এই সামর্থ্যরে চেয়ে বেশি খেলতে যাওয়ার কারণটা অনেকেরই জানা। ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লব সফলভাবে সংঘটিত হওয়ার কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তি দেশটাকে অবরোধ করে রেখেছে প্রায় ৪০ বছর ধরে। ইরানী জনগণের অর্থ আন্তর্জাতিক ব্যাংকগুলো ইঙ্গ-মার্কিন ইশারায় বাজেয়াপ্ত করে রেখেছে। পাশাপাশি চলছে বাণিজ্য অবরোধ। Most unpredictable ডোনাল্ট ট্রাম্প প্রতিশ্রুত চুক্তি ভঙ্গ করেছেন। এসবেরই প্রতিবাদ স্বরূপ এক ঘরে হয়ে থাকা ইরান দেখাতে চাইবে-‘শত বাধা থাকা সত্ত্বেও আমরাও মাথা তুলে দাঁড়িয়েছি।’ We can Make Progress more than you, and of course, it is despite of your obstruction Iranian nation is now beyond your reach.ওদিকে আরবি ভাষী মরোক্কো আমাদের এক সুহৃদ ভাই। মুসলিম উম্মাহর জন্য কিছু না কিছু করার ক্ষেত্রে ‘রাবাত’ (মরক্কোর রাজধানী) বরাবরই দৃশ্যমানভাবে সক্রিয় থাকে। যেমনটা আজকের তুরস্ক করার চেষ্টা করছে। মরক্কোর সেই অভিযাত্রা অনেক আগে থেকেই শুরু। মরক্কো ও স্পেন খুবই নিকটতম প্রতিবেশী। উত্তর আটলান্টিক ও ভূ-মধ্যসাগরকে সংযুক্তকারী সরু জিব্রাল্টার প্রণালী দেশ দুটোকে বিভক্ত করে রেখেছে। ঠিক যেনো পাক্্ প্রণালী দ্বারা বিভক্ত ভারত ও শ্রীলংকার মতো অবস্থা। এই  মরক্কো দিয়েই ইসলাম স্পেনে পৌঁছেছিল। সেখানে মুসলমানরা সুদীর্ঘ সাড়ে সাতশত বছর কাল স্পেন শাসন করে এবং ইউরোপকে রেনেসাঁ (পুনর্জাগরণ) বিপ্লবের পথ দেখায়। কিন্তু অতি দুঃখের কথা ও করুণ কাহিনী হলো ইউরোপীয় খ্রিস্টীয় শক্তি সংঘবদ্ধ হয়ে ৭৫০ বছর পর ১৫ শ’ শতাব্দীর শেষ দিকে মুসলমানদের স্পেন থেকে তাড়িয়ে দেয়। একেবারে এখনকার রোহিঙ্গা, ফিলিস্তিনের মতো ঘটনা আরকি!

১৯৩০ ও ১৯৪০ এর দশকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় স্পেন থেকে মুসলমান বিতাড়নের উদাহরণটা ভারতীয় মুসলমানদের সামনে হাজির করা হয় এবং মুসলমানরা তাতে বিশ্বাস করে ভারত থেকে বিতাড়িত হবার ভয়ে আলাদা রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা দাবির প্রতি সমর্থন জানায়। যা হোক স্পেনের সেই বিতাড়িত মুসলমানরা অবশেষে ব্যাপকভাবে মরক্কোতে আশ্রয় নিয়েছিলো। এই মরক্কোর মানব-মানবীরা বেশ সুদর্শন। এর অন্যতম কারণ তারা ভূ-মধ্যসাগরীয় নাতি শীতোষ্ণ অঞ্চলে বসবাস করে। এবারের বিশ্বকাপে মরক্কোও ইরান দেশের মতো তেতে লাল হয়ে আছে। পঞ্চম বারের মতো বিশ্বকাপ আয়োজনের আবেদন করেও ভূ-রাজনীতির কাছে পরাজিত হয়েছে। এবারে ২০২৬ সালের আয়োজক হওয়া থেকে মরক্কোকে  ঠেকানোর জন্য এক বিরল অভিনব কৌশল হাতে নেয়া হয়েছিলো। চমৎকার ছক কষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা-মেক্সিকো এই তিন সিংহ-বাঘ ও শেয়াল মিলে পানি পান করতে যাওয়া নয়নাভিরাম হরিণ শাবক মরক্কোকে হাটিয়ে দিয়েছে। আর কাপালিক ‘ফিফা’ সেই কৌশলে আলো-বাতাসের যোগান দিয়েছে। অথচ কি নেই মরক্কোতে? প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, অনকূল আবহাওয়া, উন্নত পর্যটন শিল্প, রাবাতা-ক্যাসাব্ল্যাংকার মতো আকর্ষণীয় পরিচ্ছন্ন মেগা শহর, বড় বড় ফুটবল স্থাপনা সবই আছে দুই সাগরের কন্যা মরক্কোর। সুতরাং মানে দাঁড়ালো দু’দলই নিজেদেরকে প্রমাণের জন্য রাগে আগুন হয়ে আছে। তবে এই রাগটা একে অপরের প্রতি নয়; বরং তা বিশ্ব পরাশক্তি ও তার পালিতদের প্রতি। এজন্যই বলছি দুই ভাইয়ের লড়াই। তারা যে গ্রুপ ‘বি’-তে খেলছে সেটা এবারের বিশ্বকাপের ডেথ গ্রুপ। এই গ্রুপে আছে স্পেন, পর্তুগালও। সুতরাং ইরান বা মরক্কো-উভয়েই চাইবে স্পেন বা পর্তুগালের মতো শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে মোকাবেলার আগে এই ম্যাচ থেকেই পূর্ণ পয়েন্ট অর্জন করতে। এজন্যেই বলছি জমজমাট লড়াই। এই দুটো দলের কেউ চাইবে না খেলটা ড্র হোক। তাহলে ১ পয়েন্ট করে ভাগাভাগি হবে এবং দ্বিতীয় রাউ-ে ওঠার ক্ষেত্রে দু’জনেই পিছিয়ে পড়বে। সুতরাং উভয়ের জন্যই ‘মারো না হয় বাঁচো’-এর অবস্থা। আমি চাইবো এই দুই ভাইয়ের যে কোন একজন জয়ী হয়ে দ্বিতীয় রাউ-ে যাওয়ার পথ প্রশস্ত করুক। ইরান বা মরক্কো-এই দুটের যে কোন একটি দ্বিতীয় পর্বে উঠলে প্রহ্লাদে ভেসে যাবো। সুতরাং এই ম্যাচটি সানন্দে উপভোগ করুন। উভয় দলের পাল্টাপাল্টি একাধিক গোল দেখার সম্ভাবনা আছে। প্রত্যাশা করুন যেন এক ভাই হেরে গিয়ে অপর ভাই জীবিত থাকে। তা না হলে, দু’জনে ড্র করে বাঁচতে চাইলে, দু’জনেই মরবে। [email protected]