উপাচার্য থেকে প্রধানমন্ত্রী, সোহরাওয়ার্দী পরিবারে বহু কৃতী

পুণ্ড্রকথা ডেস্ক
প্রকাশ: ২১ জানুয়ারী ২০১৯ ১৩:১৯ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ১৯৯ বার।

উপমহাদেশের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতার ফল ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট গঠন এবং নির্বাচনে তাদের অবিস্মরণীয় বিজয়। গণতান্ত্রিক রীতি ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে ‘গণতন্ত্রের মানসপুত্র’ বলে আখ্যায়িত করা হয়।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে এদেশের শান্তিপ্রিয় গণতন্ত্রকামী মানুষের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে তিনি মুসলিম লীগ সরকারের একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করেন। তিনি ছিলেন একজন দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক। রাজনীতিতে তার সুযোগ্য উত্তরসূরি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

অবিভক্ত ভারতে শিক্ষা-সংস্কৃতি-প্রশাসনিক ক্ষেত্রে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে অতনু মিত্র কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় একটি লেখা লিখেছেন। লেখাটি সমকাল অনলাইনের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-

মেদিনীপুর শহরের মিয়াবাজারে জোড়া মসজিদের অদূরে বাঁদিপাড়া। এই অঞ্চলটি সোহরাওয়ার্দী মহল্লা নামে পরিচিত। জনবসতিটির নাম হয় একটি পরিবারের পদবি অনুসারে। সোহরাওয়ার্দী পরিবার। এই পরিবারটির বহু সদস্য শিক্ষাদীক্ষায় এবং কর্মক্ষেত্রে নিজ নিজ প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়েছিলেন। অনেকেই অবিভক্ত জেলার নানা ক্ষেত্রে প্রথম বা প্রথম সারির কৃতিত্বের অধিকারী। কেউ জেলাবোর্ডের প্রথম চেয়ারম্যান, কেউ প্রথম ডক্টরেট। প্রথম উপাচার্য, প্রথম কেমব্রিজ শিক্ষিতও রয়েছেন এই পরিবারে। পরিবারের এক সদস্য হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীও। 

পরিবারটির শিকড় পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার পিংলা থানার ঘোড়ামারায়। সোহরাওয়ার্দী পরিবার সম্ভ্রান্ত বাঙালি মুসলিম পরিবার। ওবায়েদুল্লা ওবেদি সোহরাওয়ার্দী ছিলেন পণ্ডিত ব্যক্তি। আরবি ও ফার্সিতে তাঁর বুৎপত্তি ছিল। ঢাকা কলেজের এই অধ্যক্ষের দুই পুত্রের মধ্যে আবদুল্লা আল মামুন সোহরাওয়ার্দী ছিলেন মেদিনীপুর জিলা স্কুলের মেধাবী ছাত্র। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবিতে বিএ এবং এমএ-তে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন। তারপর ইংরেজি, দর্শন ও ফার্সিতে এমএ পাশ করেন। অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলায় তিনিই প্রথম ‘ডক্টরেট’। ইউরোপ থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ‘ঠাকুর অধ্যাপক’ হয়েছিলেন। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ‘স্যার’ উপাধি দেয়। 

প্রশাসনিক ক্ষেত্রে জেলাবোর্ড প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ব্রিটিশ জেলা শাসকেরাই তার চেয়ারম্যান হতেন। ১৯২০ সালে জেলাবোর্ড বেসরকারি চেয়ারম্যান নির্বাচিত করার অধিকার পেল। মেদিনীপুর জেলাবোর্ডের প্রথম চেয়ারম্যান হন আবদুল্লাহ আল মামুন সোহরাওয়ার্দী। বন্ধু বীরেন্দ্রনাথ শাসমলের আগে ১৯২৩ সালের ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত তিনিই চেয়ারম্যান ছিলেন। সেই তথ্য পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পরিষদের বোর্ডে এখনও লেখা রয়েছে। সাইমন কমিশন ও এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্যও ছিলেন। 

ওবায়েদুল্লা সোহরাওয়ার্দীর দ্বিতীয় পুত্র হাসান সোহরাওয়ার্দী ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া রেলের প্রথম চিফ মেডিকেল অফিসার। নামকরা সার্জন হাসানই দেশের দ্বিতীয় মুসলিম এফআরসিএস। ইন্ডিয়ান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের প্রথম বাঙালি সহ-সভাপতি। ব্রিটিশ মিলিটারি অফিসারের দায়িত্বেও ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমন্ত্রণে বহু ভাষাবিদ হাসান সোহরাওয়ার্দী বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘নিজাম অধ্যাপক’ পদে যোগ দেন। 

১৯৩০ সালের ৮ অগস্ট থেকে ১৯৩৪ সালের ৭ অগস্ট পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। তিনিই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম উপাচার্য। জওহরলাল নেহরুর ঘনিষ্ঠ ছিলেন। সাইমন কমিশনের পরামর্শদাতা, বেঙ্গল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলির সহকারী অধ্যক্ষের দায়িত্বও সামলেছেন। ভারত সরকারের উপদেষ্টা পদে যোগ দেন একসময়ে। ব্রিটিশ সরকার ১৯৩০ সালে তাঁকে প্রথম শ্রেণির ‘কাইজার-ই-হিন্দ’ খেতাব দেয়। বিপ্লবী বীণা দাসের হাত থেকে বাংলার গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসনকে বাঁচানোর জন্য ১৯৩২ সালে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ‘নাইট’ উপাধি দেয়। 

একসময়ে ঘোড়ামারা গ্রাম ছেড়ে মেদিনীপুর শহরের বাঁদিপাড়ায় চলে আসে পরিবারটি। এলাকার নাম হয় সোহরাওয়ার্দী মহল্লা। তাঁদের চেষ্টায় গড়ে ওঠে সোহরাওয়ার্দী মুর্শেদিয়া ইসলামিয়া বিদ্যালয়। এই বাড়িতেই ১৮৯২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর জন্ম। বাবা জাহাদুর রহিম ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি। তিনি ওবায়েদুল্লা ওবেদির ভ্রাতুষ্পুত্র। তিনিও ‘স্যার’ উপাধি পেয়েছিলেন। তাঁর মা বানু ‘সিনিয়র কেমব্রিজ’ পরীক্ষায় পাশ করা প্রথম ভারতীয় মহিলা। দাদা শাহীদ সোহরাওয়ার্দী অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা শেষে আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। ১৯৩২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বাগীশ্বরী অধ্যাপক’ হন। 

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলকাতার মাদ্রাসা থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। ১৯১১ সালে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে গণিতে স্নাতক। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবিতে এমএ। বৃত্তি নিয়ে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদালয়ে ১৯২০ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ও বিসিএল ডিগ্রি লাভ। অক্সফোর্ড ছেড়ে বার-অ্যাট-ল হিসেবে ব্রিটেনে আইন ব্যবসা শুরু করেন। 

১৯২৩ সালে কলকাতা হাইকোর্টে প্র্যাকটিস শুরু করেন। সেই সঙ্গে মুসলিম লীগে যোগ দিয়ে বাংলার আইন পরিষদে প্রবেশ। পরে চিত্তরঞ্জন দাশের স্বরাজ পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯২৪ সালের ১৬ এপ্রিল কলকাতা কর্পোরেশনের প্রথম ডেপুটি মেয়র হন। প্রথম মেয়র চিত্তরঞ্জন প্রয়াত হলে তিনি আবার মুসলিম লীগে ফেরেন।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৩৬ সালে বাংলা প্রদেশে মুসলিম লীগের মহাসচিব হয়েছিলেন। ১৯৩৭ সালে বাংলা প্রদেশে কৃষক প্রজা পার্টির প্রধানমন্ত্রী আবুল কাশেম ফজলুল হকের মন্ত্রিসভায় বাণিজ্য ও শ্রম মন্ত্রীর দায়িত্ব পান। মুসলিম লীগ সমর্থন প্রত্যাহার করলে ১৯৪১ সালে ১ ডিসেম্বর প্রথম সরকারের পতন ঘটে। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্ব হিন্দু মহাসভার সঙ্গে জোট করে পুনরায় ১২ ডিসেম্বর সরকার গঠন করেন ফজলুল হক। 

১৯৪৩ সালের জোট সরকারের পতন হলে প্রধানমন্ত্রী হন খাজা নাজিমুদ্দিন। গণসরবরাহ মন্ত্রীর দায়িত্ব পান হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। ১৯৪৫ সালের ৩১ মার্চ এই সরকারের পতন ঘটে। পরবর্তী নির্বাচনে মুসলিম লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে অবিভক্ত বাংলা প্রদেশের তৃতীয় ও দীর্ঘস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী হন সোহরাওয়ার্দী। ১৯৪৭ সালের ১৪ অগস্ট পর্যন্ত তিনি এই পদে ছিলেন। তবে মুসলিম লীগে তাঁর নিয়ন্ত্রণ কমেছিল। তিনি কলকাতায় মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর সঙ্গে শান্তির আহ্বান জানান। ১৯৪৯ সালের ৫ মার্চ চলে যান পাকিস্তানে। 

১৯৫৩ সাল থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের বহু গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন সোহরাওয়ার্দী। বিরোধী দলের নেতাও হন। ১৯৫৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর করাচি রাজভবনে প্রধান বিচারপতি এম মুনির কাছে পাকিস্তানের পঞ্চম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন মেদিনীপুরের হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। কিন্তু এক বছরের মধ্যে দলের নেতৃত্বের সঙ্গে বিবাদ ও রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বিরোধ বাধে তাঁর। সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোয় পরের বছর তাঁর সরকারের পতন ঘটে। ১৯৬০ সালে রাজনীতি থেকে অবসর নেন। 

১৯৬২ সালে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। মুক্তি পেয়ে জাতীয় ফ্রন্ট গঠনের চেষ্টা। কিন্তু অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসার জন্য লেবালনে গিয়েছিলেন। সেখানেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ৫ ডিসেম্বর মৃত্যু। ঢাকার শাহবাগে তাঁরই নামাঙ্কিত উদ্যানে তাঁর সমাধি রয়েছে। তাঁর নাতনি শাহিদা জামিল ১৯৯৯ সালে পাকিস্তানের প্রথম মহিলা আইনমন্ত্রী হন। মেদিনীপুর ছেড়ে সোহরাওয়ার্দী পরিবার এক সময়ে কলকাতার বাসিন্দা হয়েছিলেন। পার্ক সার্কাসের কাছে সোহরাওয়ার্দীদের নামে রাস্তা রয়েছে।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পাণ্ডিত্য এবং একটি দেশের প্রশাসনের উচ্চপদে ওঠার গরিমা ম্লান হয়ে যায় ১৯৪৬ সালের ১৬ অগস্ট কলকাতা হিংসায় প্রশাসক হিসেবে তাঁর ভূমিকায়। মেদিনীপুর শহরের সোহরাওয়ার্দী মহল্লায় আজও শিক্ষায় দীক্ষায় অভিজাত পরিবারটির স্মৃতি বহন করে চলেছে এক ভগ্নপ্রায় বাড়ি। খবর সমকাল অনলাইন