উত্তরপত্রের কোড নম্বর গোপন থাকেনি?

বগুড়ায় প্রাথমিকে বৃত্তি নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ: ভিএম স্কুলে কমেছে ৭১ ভাগ

পুণ্ড্রকথা রিপোর্ট
প্রকাশ: ২৯ এপ্রিল ২০১৯ ০৫:১৪ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ৩৪২ বার।

বগুড়ায় প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় বৃত্তি প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযোগ রয়েছে, কতিপয় শিক্ষক উত্তরপত্র মূল্যায়নের সময় নির্ধারিত কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বাড়তি নম্বর দিয়ে বৃত্তি লাভে সহায়তা করেছেন। যে কারণে এবছর শহরের নামি কয়েকটি স্কুলে বিগত বছরের তুলনায় বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা গড়ে ৭১ ভাগ পর্যন্ত কমেছে। 
মাত্র এক বছরের ব্যবধানে বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা অস্বাভাবিক কমে আসায় পুরো বিষয়টিকে সন্দেহের চোখে দেখছেন বঞ্চিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক এবং বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা। তারা প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষার উত্তরপত্র এবং বৃত্তির ফলাফল পুনর্মূল্যায়নের দাবি জানিয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদনও করেছেন।
সারাদেশের ন্যায় বগুড়াতেও ২০১৮ সালের ১৮ নভেম্বর পিইসি পরীক্ষা শুরু হয় এবং ২৬  নভেম্বর শেষ হয়। ফলাফল ঘোষণা করা হয় একই বছরের ২৪ ডিসেম্বর। এরপর ওই ফলাফলের ভিত্তিতে চলতি বছরের ২৪ মার্চ প্রাথমিকে বৃত্তি পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করা হয়। ঘোষিত ওই ফলাফল অনুযায়ী এবার বগুড়া জেলা থেকে ২ হাজার ৮৯ শিক্ষার্থী বৃত্তি লাভ করেছে। এর মধ্যে বগুড়া সদর উপজেলায় বৃত্তি পেয়েছে ২৯৬ জন শিক্ষার্থী।
 নিয়ম অনুযায়ী, প্রতিটি উপজেলায় পিইসি পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বরের ভিত্তিতে মোট পরীক্ষার্থীর মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বরপ্রাপ্ত প্রায় ১ শতাংশ পরীক্ষার্থীকে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি দেওয়া হয়। সাধারণ গ্রেডে বৃত্তি প্রদানের ক্ষেত্রে প্রতিটি ইউনিয়ন এবং পৌরসভার একটি ওয়ার্ড থেকে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া ৬ শিক্ষার্থীকে (৩জন ছেলে ৩জন মেয়ে) বৃত্তি দেওয়া হয়। আর যদি কোন ইউনিয়ন এবং পৌরভার কোন ওয়ার্ডে যদি বৃত্তির কোটা পূরণ না হয় তাহলে অন্য ইউনিয়ন বা ওয়ার্ড থেকে তা পূরণ করা হয়-এ ধরনের বৃত্তিকে সম্পুরক বৃত্তি বলা হয়। প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের কর্মকর্তারা জানান, একই ইউনিয়ন বা ওয়ার্ডের মধ্যে অবস্থিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পিইসি পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বরপ্রাপ্ত ৬জন করে শিক্ষার্থীকে সাধারণ বৃত্তির জন্য বেছে নেওয়া হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইতিপূর্বে এক উপজেলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উত্তরপত্র অন্য উপজেলার শিক্ষকদের দিয়ে মূল্যায়ন করিয়ে নেওয়ার নিয়ম ছিল। কিন্তু ২০১৮ সালের পিইসি পরীক্ষায় সেই নিয়ম পরিবর্তন করে যে উপজেলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেই উপজেলার শিক্ষকদের দিয়েই উত্তরপত্র মূল্যায়ন করানো হয়। একাধিক শিক্ষক জানিয়েছেন, মূল্যায়নের জন্য প্রতিটি উত্তরপত্রের ওপর যে গোপন কোড নম্বর দেওয়া হয় প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের এক শ্রেণির কর্মচারীরা তা সংগ্রহ করে কতিপয় শিক্ষককে জানিয়ে দেয়। এরপর ওই শিক্ষকরা তাদের পছন্দের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের নম্বর বাড়িয়ে দিয়েছেন।
বগুড়া আর্মড পুলিশ স্কুল ও কলেজের অধ্যক্ষ এটিএম মোস্তফা কামাল জানান, ২০১৮ সালের পিইসি পরীক্ষায় তার বিদ্যালয়ের আশরাফুল ইসলাম নামে এক শিক্ষার্থী ৫৯৪ পেলেও তার ভাগ্যে বৃত্তি জোটেনি। কিন্তু পাশের একই ওয়ার্ডভুক্ত একটি স্কুল থেকে ৫৯২ পাওয়া শিক্ষার্থী যথারীতি বৃত্তি পেয়েছে। তার প্রতিষ্ঠান থেকে মাত্র ৩জনের ভাগ্যে বৃত্তি জুটেছে এবার। বৃত্তির ফলাফল পুনর্মূল্যায়নের আবেদন জানিয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে লেখা আবেদনপত্রে এটিএম মোস্তফা কামাল বলেন, আর্মড পুলিশ স্কুল ও কলেজ থেকে পিইসি, জেএসসি, এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষায় বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী বৃত্তি পেয়ে থাকে। কিন্তু এবার পিইসিতে মাত্র ৩ জন বৃত্তি পেয়েছে যা অবিশ্বাস্য। ওই আবেদনপত্রে তিনি আরও বলেন, বগুড়া সদর উপজেলায় বৃত্তি প্রদানের ক্ষেত্রে কোন না কোন অনিয়ম হয়েছে। তদন্ত করে ফলাফল পুনর্মূল্যায়ন করা জরুরী।
বগুড়া সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের (ভিএম) প্রধান শিক্ষক রাবেয়া খাতুন জানিয়েছেন তার বিদ্যালয় থেকে ২০১৭ সালে ৫৩জন শিক্ষার্থী বৃত্তি পেয়েছিল। কিন্তু এবার তার প্রতিষ্ঠান থেকে বৃত্তি পেয়েছে মাত্র ১৫জন। তিনি বলেন, যেখানে আমাদের বৃত্তির সংখ্যা প্রতিবছরই বাড়ে সেখানে এক বছরের ব্যবধানে ৭১ ভাগ কমেছে। এটা আমাদের যেমন বিস্মিত করেছে তেমনি অভিভাবকরাও হতবাক। তাই তারা আমার মাধ্যমে জেলা প্রশাসকের কাছে উত্তরপত্র পুর্নমূল্যায়নের মাধ্যমে ফলাফল পুনর্নির্ধারণের আবেদন জানিয়েছেন। অন্য আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানেও একই ঘটনা ঘটেছে। তবে তাদের পক্ষ থেকে কোন লিখিত অভিযোগ করা হয়নি।
বগুড়া সদর উপজেলায় বৃত্তি পরীক্ষায় উত্তরপত্রে কোড নম্বর বসানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। সেখান থেকে কোড নম্বর ফাঁস করা হয়েছে শিক্ষক এবং অভিভাবকদের এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বগুড়া সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আজিজুর রহমান বলেন, ‘বৃত্তির ফলাফল নিয়ে কিছু অভিযোগ আসার পর আমি প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের খোঁজ নিতে বলেছি। যদি কোন অসঙ্গতি পাওয়া যায় তাহলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’ বগুড়ার জেলা প্রশাসক ফয়েজ আহাম্মদ জানিয়েছেন, বৃত্তির ফলাফল সংক্রান্ত অনিয়মের যেসব অভিযোগ এসেছে সেগুলো তারা মন্ত্রণালয়কে জানিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘বিষয়টি মন্ত্রণালয় দেখবে। তবে ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের কোন অভিযোগ না ওঠে সেটা অবশ্যই দেখা হবে।’