পিবিআই তদন্তে বের হয়ে আসলো নুসরাত হত্যার লোমহর্ষক মুহূর্ত

পুণ্ড্রকথা ডেস্ক
প্রকাশ: ২৮ মে ২০১৯ ১৪:৫৭ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ১৮১ বার।

ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলায় ১৬ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে বলে দাবি করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

মঙ্গলবার রাজধানীর উত্তরায় পিবিআই কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়।

পিবিআই জানায়, এই ১৬ জনকে দায়ী করে ৭২২ পৃষ্ঠার চার্জশিট চূড়ান্ত করা হয়েছে। অভিযোগপত্র বুধবার আদালতে দাখিল করা হতে পারে।

পিবিআই’র তদন্তে উঠে আসে নুসরাত হত্যার পরিকল্পনা ও হত্যার লোমহর্ষক মুহূর্ত এবং হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের নাম।

পিবিআই’র তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, নুসরাতের করা অভিযোগ ও মামলায় মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা গ্রেপ্তার হলে তার অনুগত লোকজন ক্ষিপ্ত হয়। গত ১ এপ্রিল আসামি মাদ্রাসা ছাত্রলীগ সভাপতি শাহাদাত হোসেন শামীম, নুরু উদ্দিন, ইমরান, হাফেজ আবদুল কাদের ও রানা সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে জেলখানায় দেখা করে। সেখানে সিরাজউদ্দৌলা তার মুক্তির বিষয়ে জোর প্রচেষ্টা চালাতে ও মামলা তুলে নিতে নুসরাতের পরিবারকে চাপ দিতে নির্দেশনা দেয়।

হুমকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের পরও মামলা তুলে না নিলে আসামিরা নুসরাতের ওপর ক্ষুব্ধ হয়। এছাড়া আসামি শাহাদাত হোসেন শামীম নুসরাতকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়ে ক্ষুব্ধ ছিল।

শামীম পরে কাউন্সিলর মাকসুদ ও আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিনের সঙ্গে আলোচনা করে নুসরাতকে ভয়ভীতি দেখানো ও প্রয়োজনে যে কোনো কিছু করার পরিকল্পনা করে। কাউন্সিলর মাকসুদ এ কাজে শামীমকে ১০ হাজার টাকা প্রদান করে।

ওই টাকা দিয়ে শাহাদাত হোসেন শামীম পরিকল্পনা মোতাবেক তার দূর সম্পর্কের ভাগনি কামরুন্নাহার মনিকে দিয়ে দুইটি বোরকা ও চার জোড়া হাতমোজা কেনায়।

এরপর ৩ এপ্রিল শামীম নুরু উদ্দিন ও কাদেরসহ কয়েকজনকে নিয়ে জেলখানায় অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে দেখা করে। সেখানে সিরাজউদ্দৌলা তাদেরকে নুসরাতকে ভয়ভীতি দেখানো ও প্রয়োজনে পুড়িয়ে হত্যার নির্দেশ প্রদান করেন এবং হত্যাকাণ্ডের পর ঘটনাটি আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন।

পরিকল্পনা মোতাবেক ৪ এপ্রিল বিকেল আনুমানিক ৩টার দিকে মাদ্রাসার পাশের টিনশেড কক্ষে শামীম, নুরু উদ্দিন, জোবায়ের, জাবেদ, পপি ও কামরুন্নাহারসহ আরও কয়েকজন মিটিং করে এবং নুসরাতকে হত্যার পরিকল্পনা করে। রাত সাড়ে ৯টায় পুনরায় মাদ্রাসার ছাত্র হোস্টেলে নুসরাত হত্যার পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয়।

পরিকল্পনা অনুযায়ী ৫ এপ্রিল ৫টায় ভূঁইয়া বাজার থেকে আসামি শামীম ১ লিটার কেরোসিন তেল কিনে নিজের কাছে রেখে দেয়।

এরপর ৬ এপ্রিল সকাল ৭টা থেকে সাড়ে ৭টা দিকে শামীম, নুরুদ্দিন, কাদের মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে আসে এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী ৮টা থেকে ৯টা ২০ মিনিটের মধ্যে যার যার অবস্থানে চলে যায়।

শামীম পলিথিনে করে নিয়ে আসা কেরোসিন তেল ও অধ্যক্ষের কক্ষের সামনে থেকে একটি কাচের গ্লাস নিয়ে ছাদের বাথরুমের পাশে রেখে দেয়। কামরুন্নাহার মনির কেনা দুইটি ও বাড়ি থেকে নিয়ে আসা একটিসহ মোট ৩টি বোরকা ও চার জোড়া হাত মোজা নিয়ে সাইক্লোন সেন্টারের তৃতীয় তলায় রাখে।

শামীম, জাবেদ ও জোবায়ের সাড়ে ৯টার দিকে বোরকা ও হাত মোজা পরিধান করে তৃতীয় তলায় অবস্থান করে। নুসরাত পরীক্ষা দিতে আসলে পরিকল্পনা অনুযায়ী পপি নুসরাতকে তার বান্ধবীকে মারধরের কথা বলে। নুসরাত দৌড়ে ছাদে যেতে থাকে।

নুসরাত ২য় তলায় পৌঁছালে পপি নুসরাতকে হুজুরের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিতে বলে ও ভয় দেখায়। নুসরাত মামলা তুলবে না বলতে বলতে পপির সঙ্গে ছাদে উঠলে মনি, শামীম, জোবায়ের ও জাবেদ নুসরাতের পেছনে পেছনে ছাদে যায়।

ছাদে তারা নুসরাতকে মামলা তুলে নিতে হুমকি প্রদান করে কয়েকটি কাগজে স্বাক্ষর দিতে বলে। নুসরাত স্বাক্ষর দিতে অস্বীকৃতি জানালে তারা ক্ষিপ্ত হয়।

একপর্যায়ে শামীম বাম হাত দিয়ে নুসরাতের মুখ চেপে ধরে এবং ডান হাত দিয়ে নুসরাতের হাত পেছন দিকে নিয়ে আসে। পপি নুসরাতের গায়ের ওড়না খুলে জোবায়েরকে দিলে জোবায়ের ওড়না ভাগ করে ফেলে।

ওড়নার এক অংশ দিয়ে পপি ও মনি নুসরাতের হাত পেছনে বেঁধে ফেলে। অন্য অংশ দিয়ে জোবায়ের নুসরাতের পা পেঁচিয়ে ফেলে। জাবের পায়ে গিঁট দেয়।

সবাই মিলে নুসরাতকে ছাদের ফ্লোরে ফেলে দিলে শামীম নুসরাতের মুখ ও গলা চেপে রাখে। মনি নুসরাতের বুকের ওপর চাপ দিয়ে ধরে এবং পপি ও জোবায়ের পা চেপে ধরে।

জাবেদ পাশের বাথরুমে লুকানো কেরোসিনের পলিথিন থেকে কাচের গ্লাসে নিয়ে নুসরাতের পুরো গায়ে ঢেলে দেয়। শামীমের ইশারায় জোবায়ের ম্যাচ দিয়ে নুসরাতের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়।

আগুন ধরিয়ে প্রথমে জোবায়ের ছাদ থেকে নামে। এরপর পপি ছাদ থেকে নেমে যেতে থাকে। ওই সময় মনি শেখানো মতে পপিকে ‘কাম কাম চম্পা/শম্পা’ বলে ডেকে নিচে নেমে যায়।

মনি ও পপি নিচে নেমে পরীক্ষার হলে ঢুকে যায়। জাবেদ ও শামীম সাইক্লোন সেন্টারের ৩য় তলায় গিয়ে বোরকা খুলে ফেলে। জাবেদ শামীমকে তার বোরকা দিয়ে দ্রুত নেমে পরীক্ষার হলে ঢুকে।

শামীম নেমে মাদ্রাসার বাথরুমের পাশ দিয়ে চলে যায় এবং মাদ্রাসার পুকুরে বোরকা ফেলে দেয়। জোবায়ের সাইক্লোন সেন্টার থেকে নেমে মাদ্রাসার মূল গেট দিয়ে বের হয়ে যায় এবং বোরকা ও হাত মোজা সোনাগাজী কলেজের ডাঙ্গি খালে ফেলে দেয়।

নুরু উদ্দিন সাইক্লোন সেন্টারের নিচে থেকে পুরো ঘটনার তদারকির দায়িত্ব পালন করে। মহিউদ্দীন শাকিল ও মোহাম্মদ শামীম সাইক্লোন সেন্টারের ওই সিঁড়ির সামনে পাহারারত থাকে।

মাদ্রাসার মূল গেটের পাশে ইফতেখার উদ্দিন রানা, ইমরান হোসেন মামুন, আবদুর রহিম শরীফ ও হাফেজ আবদুল কাদের পাহারারত থাকে।

হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করার পর আসামিরা নিরাপদ স্থানে সরে গিয়ে ঘটনাটিকে আত্মহত্যা বলে বিভিন্নভাবে প্রচারণা চালায়।

নুসরাত দগ্ধ অবস্থায় নিচে নেমে আসতে থাকলে কর্তব্যরত পুলিশ কনস্টেবল ও নাইটগার্ড আগুন নেভায়। ও সময় আসামি নুরু উদ্দীনও নুসরাতের গায়ে পানি দেয়। আসামি কাদের নুসরাতের ভাই নোমানকে ফোনে সংবাদ দেয়।

পরবর্তীতে নুসরাতকে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নেওয়া হয়। পরে ১০ এপ্রিল রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মারা যান অগ্নিদগ্ধ নুসরাত।