ঈদের ছুটি: সিলেট-শ্রীমঙ্গল ট্যুর প্ল্যান, দেখে নিন একবার
আবুজার বাবলা, শ্রীমঙ্গল প্রতিনিধি:
ঈদের ছুটিতে যারা সিলেট ভ্রমণের কথা ভাবছেন তাদের প্রতি পরামর্শ আপনারা আগে পরিকল্পনা করুন এবং তারপর বেড়িয়ে পড়ুন। আপনি কি জানেন সিলেটসহ আশ-পাশের জেলা-উপজেলায় দেখার এত কিছু রয়েছে যে পরিকল্পনা ছাড়া ভ্রমণে বের হলে এক সপ্তাহেও আপনি সবকিছু দেখে শেষ করতে পারবেন না। আর ভ্রমণের সুষ্ঠু পরিকল্পনা থাকলে মাত্র ৪ দিনেই আপনি মোটামুটি সবকিছু উপভোগ করতে পারবেন। ভ্রমণ পরিকল্পনায় শুরুতেই আপনাকে রাখতে হবে মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল। শ্রীমঙ্গলে একদিন কাটিয়ে আপনি রওনা হন সিলেটে।
শ্রীমঙ্গল : এখানে য়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় চা বাগান। রয়েছে আনারাস, লেবু ও রাবান বাগান। যেসব স্থান ঘুরে দেখার মত সেগুলোর তালিকা পর্যায়ক্রমে নিচে দেওয়া হলো।
[১] চা বাগান : আপনি যখন মাইলের পর মাইল চা বাগানের ভেতর দিয়ে যাবেন, তখন আপনার মনে হবে বিশ্বের সকল সৌন্দর্য্য রাশি যেন আপনার সম্মুখে।
[২] রেইন ফরেস্ট: শ্রীমঙ্গলের আট কিলোমিটার পূর্বদিকে রয়েছে ‘লাউয়াছড়া রেইন ফরেস্ট’। আছে ১ হাজার ২০০ হেক্টরের লাউয়াছড়া পার্ক। যেখানে আড়াই হাজারেরও অধিক প্রজাতির পাখি যার মধ্যে একাধিক প্রাণীর অস্থিত্ব দেশের অনান্য বনে বিলুপ্তপ্রায়। এছাড়াও ১০ প্রজাতির সরিসৃপ, বাঘ,ভাল্লুক, হরিণ, বানর, সিভিট কেটসহ অর্ধশত প্রজাতির জীবজন্তু রয়েছে। পুরো ন্যাশনাল পার্কটি শ্রীমঙ্গল ভানুগাছ পাকা মহাসড়ক ও সিলেট আখাউড়া রেলওয়ে সেকশনের রেললাইন দ্বারা ৩ খন্ডে বিভক্ত। কিন্তু রেললাইন ও পাকা সড়ক দ্বারা বিভক্ত হলে ও পার্কের ভিতর তেমন কোনো বাড়ি-ঘর না থাকায় ও ঘন জঙ্গলের কারণে একাকিত্বের তেমন কোনো সমস্যা হয় না। এমনিতে সিএনজি ভাড়া ১০০-১৫০ টাকা। তবে দরদাম করে নিলেই ভালো।
[৩] মাধবকুন্ড জলপ্রপাত: সিলেটের অন্যতম আকর্ষণ মাধবকুন্ডের জলপ্রপাত। ২০০ ফুট উঁচু, অন্যতম সর্ববৃহৎ জলপ্রপাত মাধবকুন্ড শ্রীমঙ্গল থেকে ৬০ কিলোমিটার অদূরে। মাধবকুন্ডের অবিরাম জলধারা এনে দেবে আপনাকে নিবিড় প্রশান্তি। মাধকুন্ডু যেতে হলে কার/মাইক্রোবাস ছাড়া ভালো কোনো উপায় নেই। তবে সিএনজিতেও যেতে পারেন। রিজার্ভ সিএনজিতে ৬০০-৭০০ টাকা এবং কার ২০০০-২৫০০ এবং মাইক্রোবাস ৩০০০-৩৫০০ টাকায় যেতে পারবেন মাধবকুন্ডে।
[৪] হাকালুকি হাওর: প্রায় ১৯২ বর্গকিলোমিটার জলাভূমির হাকালুকি হাওরের শ্রীমঙ্গল থেকে মাত্র এক ঘণ্টার পথ। কাদাখুঁড়ি, পানকৌড়ির ঝাঁকসহ আরো অনেক বিরল দৃশ্য দেখা যায় হাকালুকিতে। জীব বৈচিত্রে ঠাসা হাকালুকি যেতে সিএনজি ভাড়া পড়বে ৬০০-৭০০ টাকা।
[৫] বাইক্কা বিল: শ্রীমঙ্গলের হাইল হাওরের পূর্ব দিকের প্রায় ১০০ হেক্টর আয়তনের একটি জলাভূমির নাম বাইক্কা বিল। কই, শিং, মাগুর, শৈল, টাকি, গজার, আইড়, মেনি, ফলি, পাবদাসহ আরো অনেক দেশী প্রজাতির মাছ এখানে বংশ বৃদ্ধি করে পুরো হাওরে ছড়িয়ে পড়ে। এখন এই বিল মাছের জন্যেই শুধু নয়, অতিথি পাখি এবং অন্যান্য অনেক বন্যপ্রাণীর জন্যও একটি চমৎকার নিরাপদ আবাসস্থল। এটি একটি নয়নাভিরাম জলাভূমি, যেখানে হাজারো শাপলা আর পদ্মফুল ফোটে।
কীভাবে যাবেন: ঢাকা থেকে বাসে অথবা ট্রেনে যাওয়া যায় শ্রীমঙ্গল। তবে বাসে যদি যান, রাস্তা ফাঁকা থাকলে ট্রেনের আগেই পৌঁছাবেন। হানিফ, শ্যামলী, এনা, রূপসী বাংলাসহ বিভিন্ন বাস রয়েছে মহাখালী, সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে। উত্তরা-আব্দুল্লাপুর থেকে এনার যাত্রী হয়ে শ্রীমঙ্গল আসতে পারেন ঢাকার যানজট এড়িয়ে। পারাবত, জয়ন্তিকা, কালনি, উপবন ট্রেনে যাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে শ্রীমঙ্গলে। ট্রেনে ভাড়া ৩০০-৩৫০ (স্নিগ্ধা), ৩৫০ (শোভন চেয়ার), ২৫০ (সুলভ)। এসি নন এসি বাসের ভাড়া ৩৮০-৬০০ টাকার মধ্যে। এছাড়া উত্তরবঙ্গের দিনাজপুর-রংপুর-বগুড়া থেকে, হানিফ, রূপসী বাংলা, রইস, সাগরিকাসহ এসি নন এসি সরাসরি শ্রীমঙ্গল বাস সার্ভিস আছে। ভাড়া ৭০০ থেকে ১১০০ টাকার মধ্যে।
কোথায় থাকবেন: শ্রীমঙ্গলে বিগ বাজেটের পাঁচতারকা তারকা মানের ৩টি বড় হোটেল/রিসোর্ট আছে। গ্রান্ড সুলতান রিসোর্ট এন্ড গলফ্, দ্যা প্যালেস এবং দুসাই রিসোর্ট। ১৪ হাজার থেকে ৪৫ হাজার টাকা প্রতি রাত যাপনে খরচ হতে পারে। সরকারী কর্মকর্তাদের জন্য বিটিআরআই গেষ্ট হাউসে থাকতে অনলাইনে যোগাযোগ করতে হবে। মাঝামাঝি বাজটে থাকতে পারেন নভেম ইকো রিসোর্ট, লেমন গার্ডেন এন্ড রিসোর্ট, টি রিসোর্টে থাকতে পারেন ১০ থেকে ১২ হাজারের মধ্যে। এছাড়া ছোট বড় অসংখ্য হোটেল গেষ্ট হাউস রয়েছে শহর ও আশপাশের এলাকায়। শ্রীমঙ্গল ইন, হোটেল পার্ক, মহসিন প্লাজা, গ্রান্ড সেলিম, নিসর্গ, শান্তিবাড়ি, নীলবর্ণ, হিমাচল, হেরিটেজ, লিচুবাড়ি থেকে জঙ্গল বাড়ি বেছে নিতে পারেন। এগুলিতে ২হাজার থেকে ৪হাজার ৫ শ’ টাকার মধ্যে থাকতে পারেন। ১৫০০-২০০০ টাকায় (ফ্রি ক্যানস্যালেশনে) এসি রূম পেতে পারেন প্যারাডাইস লজ গেষ্ট হাউসে। নোট: হোটেল সংক্রান্তে যে কোন তথ্যেও জন্য সাহায্য পেতে যোগাযোগ করতে পারেন-আবুজার বাবলা-০১৭৮৮ ৫৫ ১২৩, তোফায়েল আহমেদ-০১৭৫৫২৬২০৫৭ ও আব্দুস শুকুর-০১৭৪৪ ৬৮৮ ৯৩৪ এই নম্বরে। এছাড়া নিরাপত্তাজনিত প্রয়োজনে শ্রীমঙ্গলে রয়েছে টুরিষ্ট পুলিশ। যোগাযোগ রতে পারেন ০১৭৬৯৬৯০৭২১ এই নম্বরে।
এবার চলুন সিলেটে
মনে রাখবেন প্রকৃতি অপার হস্ত সাজিয়েছে সিলেটকে, নান্দনিক সৌন্দর্য্যরে এক কল্পিত রাণী যেন সিলেট। শ্রীমঙ্গল থেকে ৩ ঘন্টায় ৮০ কিলোমিটার দূরত্বে সিলেট শহরের পৌঁছাতে পারেন। সেখানে দেখার স্থানগুলো নিচে দেওয়া হলো।
জাফলং : প্রকৃতি কন্যা হিসাবে সারাদেশে এক নামে পরিচিত সিলেটের জাফলং। খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত জাফলং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি। পিয়াইন নদীর তীরে স্তরে স্তরে বিছানো পাথরের স্তূপ জাফলংকে করেছে আকর্ষণীয়। সীমান্তের ওপারে ইনডিয়ান পাহাড় টিলা, ডাউকি পাহাড় থেকে অবিরামধারায় প্রবাহমান জলপ্রপাত, ঝুলন্ত ডাউকি ব্রীজ, পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ হিমেল পানি,উঁচু পাহাড়ে গহিন অরণ্য ও শুনশান নিরবতার কারণে এলাকাটি পর্যটকদেরদারুণ ভাবে মোহাবিষ্ট করে।
এসব দৃশ্যপট দেখতে প্রতিদিনই দেশী-বিদেশী পর্যটকরা ছুটে আসেন এখানে। প্রকৃতি কন্যা ছাড়াও জাফলং বিউটি স্পট, পিকনিক স্পট, সৌন্দর্যের রাণী- এসব নামেও পর্যটকদের কাছে ব্যাপক পরিচিত। ভ্রমন পিয়াসীদের কাছে জাফলং এর আকর্ষণই যেন আলাদা। সিলেট ভ্রমনে এসে জাফলং না গেলে ভ্রমনই যেন অপূর্ণ থেকে যায়।
সিলেটনগরী থেকে ৬২ কিলোমিটার উত্তর পূর্ব দিকে গোয়াইনঘাট উপজেলায় জাফলং এর অবস্থান। জাফলংয়ে শীত ও বর্ষা মওসুমের সৌন্দর্যের রূপ ভিন্ন। বর্ষায় জাফলংএর রূপ লাবণ্য যেন ভিন্ন মাত্রায় ফুটে উঠে। ধূলি ধূসরিত পরিবেশ হয়ে উঠে স্বচ্ছ। স্নিগ্ধ পরিবেশে শ্বাস-নি:শ্বাসে থাকে ফুরফুরে ভাব। খাসিয়া পাহাড়ের সবুজাভ চূড়ায় তুলার মত মেঘরাজির বিচরণ এবং যখন-তখন অঝোরধারায় বৃষ্টিপাহাড়ি পথ হয়ে উঠে বিপদ সংকুল-সে যেন এক ভিন্ন শিহরণ। সেই সঙ্গে কয়েক হাজার ফুট উপর থেকে নেমে আসা সফেদ ঝর্ণাধারার দৃশ্য যে কারোরই নয়ন জুড়ায়। জাফলং এখন দেশের অন্যতম সেরা পর্যটন স্পট।কিভাবে যাওয়া যায়: সিলেট জেলা সদর হতে সড়ক পথে দুরুত্ব মাত্র ৫৬ কি.মি। সিলেট থেকে আপনি বাস/ মাইক্রোবাস/ সিএনজি চালিত অটোরিক্স্রায় যেতে পারেন জাফলং এ। সময় লাগবে ১ ঘন্টা হতে ১.৩০ ঘন্টা। ভাড়া বাস জনপ্রতি ৫৫ টাকা মাইক্রোবাস- ১৭০০-২০০০/-টাকা সি এন জি চালিত অটো রিক্সাঃ ৮০০/ টাকা।
বিছানাকান্দি : সিলেটের ভূস্বর্গ খ্যাত বিছানাকান্দি হলো ভারতের মেঘালয় শীমান্ত ঘেষা অসাধারন এক জায়গা। মেঘালয়ের সুউচ্চ পাহার থেকে নেমে আসা শীতল জলরাশি ছোট বড় অসংখ্য পাথরের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। অসম্ভব স্বচ্ছ জলরাশিতে ইচ্ছে করে নিজেকে সমর্পণ করে দিতে।
বিছানাকান্দি যেতে হলে খুব ভোরে সিলেটের আম্বরখানা পয়েন্ট থেকে সিএনজি তে চরে বসুন হাদার বাজারের উদ্দেশ্যে। দেরি করে গেলে পাথরের পরিবর্তে শুধু মানুষের মাথা দেখতে পাবেন। সিএনজি রিসার্ভ ৪০০-৪৫০ টাকা, আর শেয়ারে গেলে জন প্রতি ৮০-১০০ টাকা নিবে। হাদার পাড় পৌচ্ছে চাইলে হাটা শুরু করতে পারেন বিছানাকান্দির উদ্দেশ্যে। ৫ কিমি হাটলেই পৌচ্ছে যাবেন বিছানাকান্দি, পথে একবার পিয়াইন নদি পার হতে হবে। হাটতে না চাইলে হাদার বাজার থেকে ইঞ্জিন চালিত নৌকা ভাড়া নিতে পারেন। ভাড়া বেশী চাইলেও দরদাম করে চড়ে বসুন। নদিতে পানি কম থাকলে নেমে ধাক্কা দেওয়া লাগতে পারে। ঘন্টা খানেকের মধ্যে পৌচ্ছে যাবেন বিছানাকান্দি।
রাতারগুল: সারা পৃথিবীতে ফ্রেশওয়াটার সোয়াম্প ফরেস্ট বা স্বাদুপানির জলাবন আছে মাত্র ২২টি। ভারতীয় উপমহাদেশ আছে এর দুইটির একটা শ্রীলংকায় আর আরেকটা আমাদের সিলেটের গোয়াইনঘাটে। স্থানীয় মানুষজনের কাছে এটা ‘সুন্দরবন’ নামেই বেশি পরিচিত। ভারতের মেঘালয়ের জলধারা গোয়াইন নদীতে এসে পড়ে, আর সেখান কার এক সরু শাখা চেঙ্গী খাল হয়ে পানিটা প্লাবিত করে রাতারগুল জলাবনকে। বর্ষা মৌসুমের প্রায় সবসময়ই পানি থাকে বনে (মে -সেপ্টেম্বর)। শীতকালে অবশ্য সেটা হয়ে যায় আর দশটা বনের মতোই, পাতা ঝরা শুস্ক ডাঙ্গা। রাতারগুল যাওয়ার পথ; প্রথম উপায় -সিলেট থেকে জাফলং- তামাবিল রোডে সারীঘাট হয়ে সরাসরি গোয়াইনঘাট পৌছানো। এরপর গোয়াইনঘাট থেকে রাতারগুল বিট অফিসে আসবার জন্য ট্রলার ভাড়া করতে হবে, ভাড়া ৯০০- ১৫০০ এর মধ্যে (আসা - যাওয়া) আর সময় লাগে ২ ঘন্টা। বিট অফিসে নেমে ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে বনে ঢুকতে হবে, এতে ঘন্টাপ্রতি ২০০-৩০০ নিবে।
কোথায় খাবেন: দেশের অনান্য শহরের মতো সিলেটও খাবারের অজ¯্র হোটেল রেস্তরা রয়েছে। পানসি, পাঁচ ভাই এর মতো চেইন রেষ্টুরেন্ট রয়েছে যাদের খাবার দাম কম। প্রায় সব ধরনের রেস্তোরাঁই রয়েছে শহরে। তবে সব ক্ষেত্রেই খাবারের দাম জেনে নেবেন।
কোথায় থাকবেন: সিলেটে অনেক ভালো মানের বড় হোটেল/রিসোর্ট আছে। রোজ ভিউ, ডালাস, হলি ইন, সিলেট ইন, অনুরাগ, সহ দেড় শতাধিক হোটেল/গেষ্ট হাউস রয়েছে। বুকিং ডটকম অথবা ট্রিভাগোর মত জনপ্রিয় সাইট থেকে আপনার পছন্দেও হোটেল বেছে নিতে পারেন সহজে। নোট: হোটেল সংক্রান্তে যে কোন তথ্যের জন্য সাহায্য পেতে যোগাযোগ করতে পারেন-আলি ওয়াসিকুজ্জামান চৌধুরী-০১৭১৩২৪২৩২৩, ০১৯৭৭২৪২৩২৩।