গানের আসল মালিক কে?
পুণ্ড্রকথা ডেস্ক
দুজনই অভিনয়ের আঙিনায় তারকাখ্যাতি পেয়েছেন। অসংখ্য নাটকে ব্যতিক্রমী সব চরিত্র দিয়ে মন ভরিয়েছেন দর্শকের। তারা উপহার দিয়েছেন অনেক দর্শকপ্রিয় সিনেমাও। তবে অভিনয়ের পাশাপাশি তারা গানেও বেশ সুপরিচিত।
অভিনয়ে মুগ্ধ করেছেন তারা বরাবরই। কণ্ঠের জাদুতেও সম্মোহিত করেছেন দুজনই। এবার নতুন একটি গানে কণ্ঠে রীতিমতো সঙ্গীতাঙ্গনে হৈচৈ ফেলে দিয়েছেন চঞ্চল চৌধুরী ও মেহের আফরোজ শাওন। দুজনে মিলে একটি লোক গানে কণ্ঠ দিয়েছেন তারা। ‘সর্বত মঙ্গল রাধে’ শিরোনামের গানটি তাদের কণ্ঠে আলোচনায় এসেছে নতুন করে। এটি ভাইরাল হয়ে পড়ে দ্রুত। তবে এই গানের বিরুদ্ধে অনলাইন পদক্ষেপ আসে। জানা গেছে আপত্তি সরলপুর ব্যান্ডের। তাদের আপত্তির কারণেই ইউটিউব ভিডিওটি কপিরাইট ক্লেইমের আওতায় 'টেকডাউন' করে।
গতরাতে সরলপুর ব্যান্ড গণমাধ্যমের কাছে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি ও কপিরাইটের কাগজপত্র পাঠিয়েছে। যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে গানটির মালিক সরলপুর ব্যান্ড।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা তারা বলছেন, 'আমরা সরলপুর ব্যান্ড ২০১০ সাল থেকে বাংলাদেশে সংগীত চর্চা করে আসছি। এ পর্যন্ত আমারা ৫০টির মতো মৌলিক গান করেছি। এর মধ্যে আমাদের লোকজ ধারার মৌলিক গান ‘যুবতি রাধে’ মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। শুধু তাই নয়, গানটি নিয়ে মানুষের মাঝে নানা ধরনের বিভ্রান্তিও ছড়িয়ে পড়েছে যে এটি ময়মনসিংহ গীতিকা থেকে সংগৃহীত একটি গান। মূলত আমাদের ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা ভোকাল ও গিটারিস্ট তারিকুল ইসলাম তপনের লেখা ও সুর করা এ গানটি সরলপুর ব্যান্ড শুরু থেকেই পরিবেশন করে আসছে। কিন্তু বিভিন্ন সময় আমাদের গানটি অনেকেই নিজের বলে প্রকাশের চেষ্টা করে এসেছেন। যার ফলে ২০১৮ সালে আমরা গানটির কপিরাইট সংগ্রহ করি।'
সরলপুর ব্যান্ড বলে, ‘যুবতি রাধে’ গানটি আমরা লেখা শুরু করি ২০০৬/২০০৭ সাল থেকে। তখনকার সময়ে আমরা কয়েকজন একদিন রাতে সারারাতব্যাপী পালাগান দেখতে যাই। যেখানে রাধাকৃষ্ণ সম্পর্কিত বিভিন্ন পালাগান হয়েছিল। যা আমাদের খুবই ভালো লাগে এবং মন কাড়ে। তারপর থেকে রাধাকৃষ্ণ’র গানগুলোর ওপর নির্ভর করে আমরা এ গানটি লেখা শুরু করি। রাধা কৃষ্ণের গল্প থেকে আমরা বিভিন্ন তথ্য-ভাবধারা, শব্দচয়ন সংগ্রহ করে থাকি। কিন্তু কোনো হুবহু কথা আমরা সংগ্রহ করিনি। আমাদের এ গানের সাথে কোথাও কোনও গানের হুবহু মিল নেই।
সরলপুর ব্যান্ড সঙ্গীতশিল্পী সুমি মির্জাকে কথিত সংগীত শিল্পী আখ্যা দিয়ে বলেন, 'গানটি নিয়ে প্রথম বিভ্রান্তি তৈরি করেন সুমি মির্জা নামের এক কথিত শিল্পী। তিনি গানটির কথা পরিবর্তন করে লেজার ভিশনের ব্যানারে তাদের ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশ করে। ইউটিউবের কমেন্টে সে আমাদের গানটিকে তিনি পালা গান, মহুয়া গান, গোয়ালিনী গানসহ নানা নামে প্রচার করেন। ঘটনার প্রেক্ষিতে আমরা তার সাথে যোগাযোগ করলে তিনি আমাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন। যার প্রেক্ষিতে আমরা আইনের আশ্রয় নিতে বাধ্য হই। পরবর্তীতে কপিরাইট অফিস থেকে আমাদের দু’পক্ষকে ডাকা হয়, সুমী মির্জা গানটিকে ময়মনসিংহ গীতিকার মহুয়া গান কিংবা গোয়ালিনী গান বলে দাবি করলেও কোনো প্রমাণ দেখাতে না পারায় দুটি শুনানীর মাধ্যমে গানটির সত্যতা প্রকাশ হয় এবং গানটির কপিরাইট আমরা পাই। পরবর্তীতে তিনি আমাদের ‘যুবতি রাধে’ গানটির সুর ও কথার অংশ হুবহু নকল করেন, ‘বিনোদিনী রাই’ নামে আরেকটি গান প্রকাশ করেন এবং সাথে সাথে গানটির কপিরাইট নিয়ে নেন।'
এখানে স্পষ্ট হচ্ছে একই গানের কপিরাইট দুই পক্ষের হাতে রয়েছে। শুধু নাম গানের পরিবর্তনের কারণে। সুমী মির্জা বুধবার রাতে ফেসবুকে লিখেছেন, 'যে নিয়মে গান কপিরাইট হয় ঠিক একই নিয়মে আমার লিখা বিনোদিনী রাই কপিরাইট স্বীকৃতি পেয়েছে।' তার সার্টিফিকেট তিনি পোস্ট করেছেন। সুমি মির্জাকে একজন মন্তব্য করেন, 'গানটির আসল লেখকের নাম জাতি জানতে চায়।' সুমি উত্তরে বলেন, আমরাও। অর্থাৎ তিনি কপিরাইট সার্টিফিকেট পাওয়া সত্ত্বেও গানের প্রকৃত লেখকের নাম জানতে চান।
জানা গেছে, 'যুবতী রাধে' গানটি সরলপুর ব্যান্ড গ্রাম-গঞ্জের এক বাউলশিল্পী/ সাধকের কাছ থেকে গানটা সংগ্রহ করেছিল। এ গানের কপিরাইট নিয়ে এখনও একটি অভিযোগ পর্যালোচনাধীন রয়েছে, তার সঠিক সুরাহা হয়নি বলে জানা গেছে।
মার্জিয়া তুরিন অবশ্য নিজেই এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘২০০৮ সালে বকশিগঞ্জের এক সাধুর কাছ থেকে গানটি পাই। তখন তিনি খুবই বৃদ্ধ ছিলেন, তার সঙ্গে একজন সাধন সঙ্গীনীও ছিলেন। এই সাধুর কাছে পুরো গানটি পাইনি, ৩০ ভাগ পেয়েছিলাম। তারপর আমাদের ব্যান্ড দলের সদস্য আল আমিন ভাই এবং তপন বাকি সত্তর ভাগ গান রচনা করেন। পরে গানটির কম্পোজিশন করেন তপন অর্থাৎ আমার স্বামী। ২০১২ সালে গানটি আমরা রেকর্ড করি।'
গানটির সংগীত আয়োজন করেছেন পার্থ বড়ুয়া। পার্থ বড়ুয়ার বরাত দিয়ে চঞ্চল চৌধুরী বলেন, 'পার্থ দার সাথে কথা হয়েছে বুধবার রাতে। তিনি বললেন, আমরা তো জানতাম না এই গানের কথা অন্য কেউ লিখেছেন। জানলে তো আর সংগৃহীত লিখতাম না। ওরা যদি কাগজপত্র দেখিয়ে বলত, অবশ্যই তাদের ক্রেডিট দিতাম। তার মানে এই নয়, অভিযোগ করে ইউটিউব থেকে গান নামিয়ে দিতে হবে! আমি বা পার্থদা আমাদের কারো ফোন নম্বর জোগাড় করা কঠিন কিছু না। আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ব্যর্থ হওয়ার পরে কপিরাইট ক্লেম করতে পারত।'
চঞ্চল চৌধুরী বলেন, এই যে ‘বকুল ফুল বকুল ফুল’ গানটা, এটা কিন্তু বাংলাদেশে সবার আগে আমার কণ্ঠে রেকর্ড হয়েছে। এরপর ‘জলের গান’ করেছে, তারও পরে মুন্নী (দিনাত জাহান) আপা। একজনের কাছ থেকে মোবাইলে রেকর্ড করে এনে গেয়েছিলাম। জিজ্ঞেস করেছিলাম? কোথায় পেলেন কার গান এটা? কিছুই বলতে পারেনি। প্রচলিত একটা গান। তো আমি কি এই গানের কপিরাইট দাবি করব!
এদিকে, সরলপুর ব্যান্ডের প্রধান শিল্পী মার্জিয়া তুরিন ও প্রধান গিস্টারিস্ট তরিকুল ইসলাম তপন তাদের ফেসবুকে এক ভিডিওবার্তায় সব মাধ্যম থেকে আইপিডিসি ফাইন্যান্স লিমিটেডকে গানটি সরিয়ে নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন। অন্যথায় আইন অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে জানিয়েছে ব্যান্ড দলটি। আগামীকাল গানটির কপিরাইটের কাগজপত্রসহ লিখিত বিবৃতি প্রকাশ করবে বলেও জানিয়েছে।
অন্যদিকে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিষয়টি নিয়ে বেশ হৈচৈ হচ্ছে। অনেকেই শাওন-চঞ্চলের গানটি নামিয়ে দেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সদ্য পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সরলপুর ব্যান্ড সংগৃহীত কথাটি উল্লেখ করেনি। সঙ্গীতশিল্পী লুৎফর হাসান নিজের ফেসবুকে লিখেছেন, 'চঞ্চল চৌধুরী ও মেহের আফরোজ শাওনের গাওয়া গানটি একদিনেই ভয়াবহ ভাইরাল হয়েছিল। এই গান সমস্ত গানের রেকর্ড ভেঙে দিত। কপিরাইট ক্লেইমের কারণে গানটি নামিয়ে ফেলতে হয়েছে। লোকজ গানের মূল ভাবের সাথে নিজে এক দুই অন্তরা যুক্ত করে কেউ কপিরাইট নিজের নামে করে নিতে পারে, এ বড় অদ্ভুত দৃশ্য। এই দেশ ছাড়া আর কোথাও দেখা যাবে না এমন। একটা গান উড়ছিল, ডানা ভেঙে দিয়ে পাপ করেছেন আপনারা, পাপ।'
অবশ্য একদিনে PUBG BOT ARMY নামের চ্যানেল শাওন ও চঞ্চলের ভিডিওটি ইউটিউবে আপলোড করেছে, যা এখনো অক্ষত রয়েছে।