নিঃশেষ হওয়ার প্রান্তে বাংলাদেশের চিতাবাঘ

পুণ্ড্রকথা ডেস্ক
প্রকাশ: ০৭ জুন ২০২১ ০৭:৫৬ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ১০১ বার।

বাংলাদেশে অতি বিপন্ন চিতাবাঘ। রাজকীয় প্রাণীটি এশীয় বুনো বিড়াল প্রজাতির মধ্যে বাঘের পরেই শক্তি এবং ক্ষিপ্রতায় শক্তিশালী প্রাণী হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশে একসময় এর দেখা মিললেও দিনে দিনে তারা হারিয়ে যাচ্ছে। একটি গবেষণা তথ্য মতে, দেশে গত ১৩ বছরে ২১টি চিতাবাঘের উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে।

সঠিক উপায়ে তাদের রক্ষা করতে পারলে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারে এদের অবস্থান। চিতাবাঘের শেষ আশার আবাসস্থল হতে পারে হবিগঞ্জের রেমা-কালেঙ্গা, মৌলভীবাজারের লাটি ঠিলাসহ সীমান্ত এলাকার বন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডার কুইবেক বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশের বন বিভাগ এবং ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্স যৌথভাবে দেশের চিতাবাঘ নিয়ে একটি গবেষণা করেছে। গবেষণা পত্রটি একটি আন্তর্জাতিক জার্নালে গত ১৪ মার্চ গ্রহণ হয়েছে এবং প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে।

দেশে চিতাবাঘ থাকলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে গবেষণা, সংরক্ষণ বা এর বৈশিষ্ট্য জানার জন্য কখনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বিশ্বে চিতাবাঘ আছে এমন দেশে মধ্যে বাংলাদেশ একমাত্র দেশ যারা এর সংরক্ষণ বা গবেষণার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।

২০১৬ সালে আইইউসিএন থেকে চিতাবাঘকে বাংলাদেশের জন্য অতি বিপন্ন তালিকায় যুক্ত করা হয়। যৌথ গবেষণায় উঠে এসেছে বাংলাদেশের চিতাবাঘের নানা তথ্য। এমনকি গবেষণা শেষ হওয়ার পর গত মার্চ মাসে সাঙ্গুতে একটি চিতাবাঘ দেখতে পেয়েছে ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্স। সেই মুহূর্তের ছবিও তুলেছেন তারা। এর আগে সংস্থাটি ২০১৫ সালে ক্যামেরা ট্র্যাকিং করলে তার মধ্যেও ধরা পড়ে চিতাবাঘের অস্তিত্ব। এর আগে বিভিন্ন সময় চিতাবাঘ এবং এর পায়ের ছাপ ও মলের দেখা পান কয়েকজন বন্যপ্রাণী গবেষক।  

গবেষণার সূত্রে জানা যায়, ২০০২ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত গবেষণাটি চলে। এ সময়ের ভেতর ২১টিসহ মোট ২২টি চিতাবাঘের উপস্থিতির বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে। তার মধ্যে সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জের রেমা কালেঙ্গায় ১টি, চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকায় ৬টি, ২টি টেকনাফের বনাঞ্চলে,  আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে উদ্ধার হয় চারটি এবং একই সময়ে দেশে সাতটি চিতাবাঘকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ঢাকা ও নারায়ণঞ্জ থেকে উদ্ধার হয় চামড়া। গবেষণা শেষ হওয়ার পর চলতি বছরের মার্চে ক্রিয়েটিভ কনজারভেশনের ক্যামেরা ট্রাকিংয়ে ১টি চিতাবাঘ পার্বত্য অঞ্চলে ধরা পরে এতে মোট ২২টির অস্তিত্ব মেলে দেশে।

তবে গবেষকরা বলছেন বৃহৎ আকারে গবেষণা ছাড়া দেশে চিতাবাঘের প্রকৃত সংখ্যা বের করা খুব কঠিন। এরা গভীর বনে লুকিয়ে থাকতে পছন্দ করে। আর এদের বসতি এলাকা বিস্তীর্ণ। তাই এদের প্রকৃত সংখ্যা জানতে বৃহত্তর কর্মযজ্ঞের প্রয়োজন। টেকনাফে দেখা পাওয়া সেই চিতাবাঘের স্থানে বর্তমানে রোহিঙ্গা ক্যাম্প থাকায় সেখানে এদের অস্তিত্ব সেখানে আছে কিনা সে বিষয়ে কোনো তথ্য নেই।

২০০২ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশে দেখা গেছে এমন চিতাবাঘের ধরন, বৈশিষ্ট্য এবং পরিণতি নিয়ে তারা একটি মূল্যায়নও করেছে।

তাতে দেখা গেছে, ওই সময়কালে দেশে ২১টি চিতা বাঘ দেখা গেছে। এর মধ্যে সাতটি চিতাকে গ্রামবাসী পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। মেরে ফেলার সব ঘটনা ঘটেছে দেশের উত্তরাঞ্চলে।

গবেষক দলের সদস্য ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্সের কর্মকর্তা ও গবেষক শাহরিয়ার সিজার রহমান জানান, দেশের উত্তরাঞ্চলের বেশিরভাগ চিতাবাঘকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এই এলাকায় চিতা বাঘ বেশী আসার কারণ হচ্ছে তিস্তার উজানে ভারতীয় অংশের বনভূমিতে চিতাবাঘ বেশ ভালো পরিমাণে আছে। যেখান থেকে বাংলাদেশে তারা ঢুকে মানুষের হাতে প্রাণ হারায়। এরা মানুষের হাতে যেমন প্রাণ হারায়, তেমনি নষ্ট হচ্ছে এদের বাসস্থান।

কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ার সংরক্ষিত বনভূমির প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, এই বনে একসময় বেশ কয়েকটি চিতাবাঘ দেখা গিয়েছিল। রোহিঙ্গা শিবির তৈরি করায় সেখান থেকে চিতা বাঘগুলোর খুবই স্বাভাবিকভাবে অন্যত্র চলে গেছে। বনভূমি রক্ষা এবং মানুষকে সচেতন করতে হবে সেই সঙ্গে আমাদের আন্তরিকতা থাকলে আমরা সারাবিশ্বের মাঝে চিতাবাঘ সংরক্ষণ করে উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারি। এ জন্য প্রথমে হত্যা বন্ধ করতে হবে। বন আইনের প্রয়োগ করতে হবে। দেশের বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইনে প্রাণী হত্যার বিচারের বিধান থাকলেও সাতটি চিতাবাঘ হত্যার কারণে কারো কোনো শাস্তি হয়েছে এমন তথ্য নেই।

গবেষক দলের নেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক মুনতাসির আকাশ জানান, এদের হত্যা বন্ধ করতে হবে। সেই সঙ্গে সরকারকে প্রয়োজনীয় গবেষণা ও সংরক্ষণ কৌশল নিয়ে উদ্যোগ নিতে হবে। বিড়াল প্রজাতির সবচেয়ে বড় প্রজাতির প্রাণী বেঙ্গল টাইগার নিয়ে জানতে গত ১০ বছরে প্রায় শত শত কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে । রয়েল বেঙ্গলের বিভিন্ন তথ্য পেতে সাহায্য করেছে ২৮টি আলাদা আলাদা গবেষণা কিন্তু চিতাবাঘ নিয়ে উদ্যোগ নেয়া হয়নি। সংরক্ষণ করতে হলে আগে জানতে হবে তাদের বিস্তারিত। এ জন্য গবেষণার প্রয়োজন। সরকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিলে এই দেশে চিতাবাঘের অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব। এবং সেটা বিশ্বে কাছে দৃষ্টান্ত হবে।

তিনি জানান, বিশ্বে এক প্রজাতিরই চিতাবাঘ আছে। উপপ্রজাতি আটটি। ভারতীয় উপমহাদেশে তিনটি পাওয়া যায়। ভারতীয় চিতাবাঘ, ইন্দোচাইনিজ চিতাবাঘ ও পারসিয়ান চিতাবাঘ। বাংলাদেশে শুধু ভারতীয় উপপ্রজাতি ছিল। এছাড়া চিতা ছিল উত্তরাঞ্চলে। সেটি ১৮ শতকের শেষের দিকে হারিয়ে যায়। চিতাবাঘ আশির দশকেও বাংলাদেশের অনেক জায়গায়ই ছিল। প্রয়োজনীয় গবেষণা, চিতাবাঘের জন্য সংরক্ষিত এলাকা, প্রটেক্টেড এরিয়ার বাইরে প্রাণী সংরক্ষণের উদ্যোগ নিলে চিতাবাঘ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারে।

গবেষণায় উঠে এসেছে চিতাবাঘ পাচারের কথা। গবেষণার সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চারটি জীবিত চিতাবাঘ উদ্ধার করেছে । এগুলো ভারত থেকে বাংলাদেশ হয়ে থাইল্যান্ড পাচার হচ্ছিল।

প্রাণী বিশেষজ্ঞরা বলেছেন তাদের চোখে বিভিন্ন সময় বাংলাদেশে চিতাবাঘের অস্তিত্ব ধরা পড়েছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ড. মনিরুল এইচ খান জানান, পার্বত্য অঞ্চল, সিলেটের সীমান্ত এলাকা, হবিগঞ্জের রেমা-কালেঙ্গা বন এবং মৌলভীবাজারের জুড়ির লাঠিটিলা বনে এরা আছে। আমি কয়েক বছর আগে হবিগঞ্জের রেমা-কালেঙ্গা বনে দুটি চিতাবাঘের উপস্থিতি পেয়েছি। গরু শিকার করে খাওয়ার পর আমি গিয়ে সেখানে চিতাবাঘের পায়ের ছাপ দেখি। এর আগেও এই বনে আমি এদের ডাক শুনেছি। দেশে কতটা আছে সেটা বলা মুশকিল তবে খুব নগণ্য অবস্থায় আছে।

তিনি বলেন, সর্বোচ্চ ৫০টির মতো চিতা বাঘ থাকতে পারে তবে সেটা শুধুই ধারণা। সিলেটের সীমান্তবর্তী এলাকায়, পার্বত্য অঞ্চল ও মৌলভীবাজারের জুড়েতে লাঠি টিলায় এদের শেষ আবাস্থল, এসব এলাকায় এরা থাকায় কারণ এসব এলাকায় জঙ্গল বেশি। যেহেতু প্রাণীটি ঘন জঙ্গলে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পছন্দ করে তাই এসব জায়গায় এদের অবস্থান। তবে আমরা যদি এদের আবাস্থল রক্ষার পাশাপাশি নতুন আবাস্থল তৈরি করতে পারতাম, নিশ্চয় দিনে দিনে এদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেত। তবে নতুন করে আবাসস্থল তৈরি করতে না পারলেও এখন যে সব জায়গায় অবস্থান করছে তা যেন অন্তত আমরা ধরে রাখি এবং এদের খাবারের নিশ্চয়তা দিতে হবে। যেমন হরিণ, বানর, খরগোশ যদি এসব বনে থাকে তাহলে তা চিতাবাঘের জন্য ভালো।

বাংলাদেশের সিলেট–চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন বনাঞ্চলে ছিল বাঘ, চিতাবাঘসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর আবাস্থল ছিল। এমনকি কয়েক দশক আগেও পার্বত্য চট্টগ্রামে অবস্থান করত বেঙ্গল টাইগার আর চিতা বাঘ। সিলেটের বিভিন্ন এলাকায় দেখা যেত চিতাবাঘ। ইতিমধ্যে সুন্দরবন ছাড়া দেশের কোথাও আর রয়েল বেঙ্গলের দেখা মেলে না । চিতাবাঘের যেহেতু রয়েল বেঙ্গলের মতো নির্দিষ্ট কোন জায়গা নেই, তাই তাদের অবস্থান রক্ষা করতে হলে আরো সচেতন এবং উদ্যোগী হতে হবে।

বাংলাদেশে ভারতীয় চিতার মধ্যে অতি দুর্লভ কালো চিতাও দেখা গেছে। ১৯৯০–এর দশকে বান্দরবানের রেমাক্রি ও আলীকদমে কালো চিতা দেখা গিয়েছিল। তবে এটি চিতার কোনো উপপ্রজাতি না। চামড়ায় মেলানিনের পরিমাণ বেশি থাকলে চিতা বাঘের রং কালো হয়ে যায়। সাধারণত দক্ষিণ এশিয়া ও পূর্ব এশিয়ার গভীর বনভূমিতে এমন কালো চিতা দেখা যায়