নওগাঁর ভ্রমণ পিপাষু দর্শকদের বাড়তি আকর্ষণ আলতাদীঘির পদ্মফুল
এম আর ইসলাম রতন,নওগাঁ
নওগাঁর ধামইরহাটে সীমান্ত সংলগ্ন বিশাল সবুজ ছায়াঘেরা জাতীয় উদ্যানের মাঝে প্রকান্ড এক দীঘি। এই দীঘির নামই আলতাদীঘি। জেলার সর্ববৃহৎ ও প্রাচীন ইতিহাসসমৃদ্ধ এ দীঘি এখন সময়ের সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ লাল পদ্মফুল। সচরাচর এই এলাকায় খুবই কম চোখে পড়ে এই লাল পদ্মফুল। স্বচ্ছ পানিতে ফুটে ওঠা হাজারো পদ্মফুল যেকোনো ভ্রমণপিপাসু দর্শকতের বিমোহিত করবে।
ধামইরহাটের আলতাদীঘি জাতীয় উদ্যানকে ঘিরে পর্যঠকদেরতো আনোগোনা লেগেই আছে। তবে এই লাল পদ্মফুলকে কেন্দ্র ওই বরে যাওয়ার জন্য মানুষকে আরো আকর্ষণ করছে। শুধু তাই বর্তমানে বর্ষাকালে এই দৃশ্য দেখার জন্য যেমন মানুষ ছুটে আসে এই বনে। ঠিক শীতের মৗেসুমেও পরিযায়ী পাখি, ডাহুক, পানকৌড়ির ওড়াউড়ির মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখার জন্য মানুষ অধির আগ্রহে অপেক্ষা করে।
স্থানীয় উপজেলা বনবিট কর্মকর্তা আব্দুল মান্নান জানান জেলার ধামইরহাট উপজেলার ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানের মধ্যে আলতাদিঘি অন্যতম। প্রায় ২৬৪.১২ হেক্টর এই বনভূমির মধ্যে দিঘিটির আয়তন ৪৩ একর। এটি দৈর্ঘ্যে ১১০০ মিটার এবং প্রস্থে ৫০০ মিটার। দীঘির পাড় গুলো উঁচু এবং দক্ষিণ পাড় শালবনে ঢাকা। পুরো জায়গায় শোভা পাচ্ছে রাশি রাশি পদ্মফুল। প্রাচীন দীঘিগুলোর মধ্যে এটিই বোধ হয় বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ সচল দীঘি। এই দীঘির চারিপাশে ৪ ফিট চওড়া ইটের রাস্তা রয়েছে। জায়গায় হায়গা বসানো হয়েছে পাকা সীট বেঞ্চ। আবার এই বনভূমির মোট পরিমাণ ১৪০১.৬৯ একর। ভারতের কোল ঘেঁষে আলতাদিঘি ও তৎসংলগ্ন বন এলাকার ২৬৪.১২ (৬৫২.৩৭ একর) হেক্টর জায়গাকে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের ২০১১ সালে ‘‘আলতাদীঘি জাতীয় উদ্যান’ ঘোষণা করেন। বিশাল দীঘি রামসাগরের দৈর্ঘ্য এটির চেয়ে ১৫০ মিটার বেশি হলেও চওড়ায় ১৫০ মিটারের কম। আর রামসাগর ১৭৫০ সালের দিকে খনন করা হয়। কিন্তু আলতাদিঘি পাল রাজ্য শাসনের যুগের দীঘি।
এদিকে জনশ্রুতি রয়েছে বরেন্দ্র অঞ্চলে একসময় প্রবল খরার কারণে মাঠ-ঘাট সব পুড়ছিল চরম পানীয় সংকটে। প্রজাদের দাবির কারণে স্থানীয় জগদল বিহারের (১০৭৭-১১২০ খ্রিষ্টাব্দে) রাজা রামপাল ও সদর পালের রাজ্য শাসনের সময় রাজমাতা পূত্রের কাছে বর চাইলেন। ওয়াদা করিয়ে নেন, সকালে ঘুম থেকে ওঠে আমি যতদূর পর্যন্ত পায়ে হেঁটে যেতে পারব, ততদূর পর্যন্ত একটি দীঘি খনন করে দিতে হবে। রাজমাতা পায়ে হেঁটে চলেছেন তো চলেছেন আর থামেন না। রাজা, উজির, নাজির পড়লেন বেকায়দায়। এত লম্বা দীঘি খনন করবেন কী করে? তাই কৌশলে মায়ের পায়ে আলতা ঢেলে দিয়ে পা কেটে গেছে বলে তার চলার পথ বন্ধ করে দেন। সেই থেকে এই দীঘির নামকরণ করা হয় আলতাদিঘি।
পাশের পত্নীতলা উপজেলার নজুল ইসলাম স্বপরিবারের ঘুরতে এসেছেন আলতাদীঘি জাতীয উদ্যান। তিনি বলেন সবুজ ছায়া ঘেরা এই বন সত্যিই বিমোহিত করেছে। বিশেষ করে আলতাদীঘির ফুঠে উঠা লাল পদ্ম যেন নযন কাড়ছে। সুযোগ পেলে বার বার এখানে ছুটে আসব। একই কথা বলেন আত্রাই উপজেলার বাসিন্দা আব্দুল লতিফ ও নাটোরের সিংড়া থেকে আসা মোজাফ্ফর হোসেন। তারা বলেন এখানে ঘুরতে ও সময় কাটাতেই ভালয় লাগছে তবে নিরাপত্তার অভাব বোধ করছি। এখানে কোন নিরাপত্তাকর্মী নেই। নেই কোন বিশ্রামাগার। এমনকি খাবারের জন্য গড়ে তোলা হয়নি কোন রেষ্টুরেন্ট।
এদিকে বনবিট কর্মকর্তা আবদুল মান্নান বলেন জাতীয় উদ্যান ঘোষণার পর ধামইরহাট উপজেলা সদর থেকে শালবন বনাঞ্চল ও আলতাদিঘি পর্যন্ত পাকা সড়ক তৈরি করা হয়েছে। বর্তমানে বাস, মাইক্রোবাস, ভটভটি ও রিকশা-ভ্যানযোগে ধামইরহাট থেকে আলতাদিঘি পর্যন্ত চার-পাঁচ কিলোমিটার পথ অনায়াসে পাড়ি জমানো সম্ভব। প্রাকৃতিক পরিবেশে গড়ে ওঠা শালবাগানে বন বিভাগের উদ্যোগে ইতোমধ্যে ঔষধিসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা, বাঁশ ও বেত লাগিয়ে বন্য ্প্রাণী ও পাখির অভয়ারণ্য হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। এ বনাঞ্চলে অজগর, হুনুমান, বানর, গন্ধগোকুল, বেজি, সজারু, মেছোবাঘ, বনবিড়াল, শিয়ালসহ প্রায় ২০ প্রজাতির পাখি অবমুক্ত করা হয়েছে। একদিকে পর্যটক ও দর্শকদের আনন্দ ও বিনোদন যেমন বেড়েছে, তেমনি এ অঞ্চলের প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজার রাখার জন্য এ বনাঞ্চল যথেষ্ট অবদান রাখছে।
তবে এলাকাবাসীর অভিযোগ কোলাহল, বনভূমি সংকোচন ও বন্য প্রাণী হত্যার ফলে ধামইরহাট শালবন এলাকার জীববৈচিত্র এখন হুমকির মুখে। প্রাকৃতিকভাবে শালগাছ এখানকার প্রধান বৃক্ষ হলেও আজ তা ক্ষয়িষ্ণু প্রজাতীর বৃক্ষ। সহযোগী প্রজাতি যেমন আমলকী, হরীতকী বহেরা, শিমুল, কুম্ভি, তেন্ডু ইত্যাদি এখন আর নেই বললেই চলে। খাদ্য ও বাসস্থানের অভাবে এলাকাটি এখন বন্য প্রাণীশূন্য। অথচ একদা এলাকাটি প্রচুর শিয়াল, বেজি, বনবিড়াল, খেঁকশিয়াল, গুইসাপ ও হরেক রকমের পাখির কলকালিতে পরিপূর্ণ ছিল।
নওগাঁ জেলা সদর থেকে প্রায় ৫৬ কিলোমিটার উত্তর ভারতীয় সীমান্তের কোল ঘেঁষে এবং জয়পুরহাট জেলা শহর থেকে ১৯ কিলোমিটার পশ্চিমে নির্জন বনের গভীরে জাতীয় উদ্যান আলতাদীঘির অবস্থান। এই জাতীয় উদ্যানকে ঘিরে আরো বড় পরিসরে পর্যঠক আকর্ষণে এখনই উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন কলে মনে করছেন এলাকাবাসী।