হারায়ে খুঁজি সেই দিনগুলি

পাঞ্জাবিতেই পাঁচ কন্যার ঈদ

জান্নাতুল ফেরদৌস লুবনা
প্রকাশ: ০২ মে ২০২২ ১৪:৩৪ ।
বিশেষ
পঠিত হয়েছে ৬১ বার।

শহরের সড়কগুলোতে এখন যেন পা ফেলানোরও আর জায়গা নেই। একই অবস্থা ফুটপাত আর মার্কেটগুলোতেও। সবখানেই মানুষের উপচে পড়া ভিড়। সাধ্য অনুযায়ী যে যা পারছেন নিজের জন্য, পরিবারের সদস্যদের জন্য এবং আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের জন্য কেনা-কাটা করছেন। ঈদকে ঘিরে কেনা-কাটার এই দৃশ্য খুবই পরিচিত। যা আমরা সেই ছোট্ট বেলা থেকেই দেখে আসছি। 

 

কিন্তু অদৃশ্য এক ভাইরাস যেটি কোভিড-১৯ নামে পরিচিত তার ছোবলে ইতিপূর্বে এসব রীতি-নীতি যেন লণ্ডভণ্ড  হয়ে গিয়েছিল। অত্যন্ত সংক্রামক ওই ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে ২০২০ সালের মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে আমরা ঘরবন্দী হয়ে পড়েছিলাম। সে কারণে গত দুই বছর ঈদ এসেছে কিন্তু আমরা তা উদযাপন করতে পারিনি। কেনা-কাটা তো দূরের কথা ঈদের নামাজও আদায় করতে পারেন নি অনেকে। বিষাদময় এমন ঈদ আমরা আগে কখনও দেখিনি। আলহামদুল্লিাহ্ করোনার সংক্রমণ কমে আসায় এবার ঈদকে উপলক্ষ্য করে ঘরে ঘরে চিরায়ত উৎসবের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। ভাবছি ঈদটা যদি অন্তত পনের দিন পরে হতো তাহলে কেনা-কাটা করতে আসা মানুষের ভিড় আরও বাড়তো। কারণ ততদিনে নতুন ধান উঠতো এবং হাটে-বাজারে ও আড়তে কেনা-বেচার ধুম পড়ে যেত। তাতে অবস্থা সম্পন্ন কৃষকের পাশাপাশি ধান কাটা-মাড়াইয়ে অংশ নেওয়া প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষগুলোরও আয়-রোজগার বাড়তো।

 

কয়েক ঘন্টা পর শাওয়ালের অর্থাৎ ঈদের চাঁদ উঠবে। আজ অনেক কিছুই মনে পড়ছে। ফেলে আসা শৈশবে ঈদ উদযাপনের কথাগুলোই বার বার মনে পড়ছে। হয়তো সবারই এমন হয়। কারণ সেই দিনগুলো যে আর কখনও ফিরে পাওয়া যাবে না। আজ আমার মরহুমা আম্মার কথাই সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছে। কারণ তাঁর কারণে আমাদের শৈশবের ঈদটা ছিল ব্যতিক্রমী।

 

আম্মার কাছে ঈদের দিনে সবচেয়ে আকর্ষণীয় পোষাক ছিল পাঞ্জাবি। ওইদিন ছেলেরা পাঞ্জাবি পড়ে, ঈদগাহে যায়, ঘুরে বেড়ায়- এগুলো আম্মার খুব পছন্দ ছিল। তবে তাঁর তো কোন ছেলে সন্তান ছিল না; ছিলাম আমরা পাঁচ বোন। ছেলে সন্তান না থাকার কারণে আম্মার হয়তো আক্ষেপ ছিল কিন্তু সেটা নিয়ে তার মধ্যে হতাশা ছিল না। বরং বছরের সেই একটি দিন অর্থাৎ ঈদের দিন তিনি তাঁর পাঁচ কন্যাকে পুত্র হিসেবে বিবেচনা করতেন। এজন্য বিশেষ ওই দিনটিতে নিজের চোখ জুড়ানোর জন্য আম্মা আমাদের পাঁচ বোনকে পাঞ্জাবি পড়াতেন।

 

প্রতি বছর ঈদের আগে আম্মা মার্কেট থেকে পাঞ্জাবির কাপড় কিনতেন। তারপর টেইলার্স থেকে পাঞ্জাবি তৈরির পর বাসায় এনে সেগুলোকে আকর্ষণীয় করতে নিজেই হাতের কাজ করতেন। ঈদের দিন গোসলের পর আম্মা পাঞ্জাবিগুলো আমাদের পাঁচ বোনকে পড়াতেন। এরপর আব্বার সঙ্গে বাড়ির পাশে এম এস ক্লাব মাঠ সংলগ্ন মালতিনগর কেন্দ্রীয় ঈদগাহে পাঠাতেন। মনে আছে যতক্ষণ নামাজ শেষ না হতো ততক্ষণ আমরা ঈদগাহের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতাম। পরে পাঞ্জাবি পড়ে আমরা ছেলেদের মতই ঘুরতে বের হতাম। ক্লাস ওয়ান থেকে সিক্স-সেভেন পর্যন্ত পাঞ্জাবিতেই আমাদের ঈদ কেটেছে।

 

আম্মার মত পাঞ্জাবির প্রতি আমারও বিশেষ দুর্বলতা রয়ে গেছে। তবে নিজে যেহেতু পড়তে পারি না সেজন্য ঈদের গিফট আইটেম হিসেবে পাঞ্জাবিই আমার প্রথম পছন্দ। এবার ঈদে আমি আমার স্বামী-সন্তান এবং বন্ধুদের স্বামী-সন্তানদের জন্য একই কাপড়ের তৈরি পাঞ্জাবি গিফট করেছি। জানি না তারা সবাই ঈদের দিন সেই পাঞ্জাবিগুলো পড়তে পারবেন কি’না? তবে মনের চোখ দিয়ে একই পাঞ্জাবিতে তাদেরকে আমি দেখছি আর আমার চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে, ঠিক যেমন আমাদের পাঁচ বোনকে পাঞ্জাবিতে দেখে আম্মার চোখ জুড়াতো!

 

ঈদের দিন সালামি দেওয়া-নেওয়ার প্রসঙ্গে অনেক গল্প আমরা শুনি। তবে সালামি নিয়ে আমাদের পাঁচ বোনের গল্পটা একটু আলাদা। কারণ আমরা সালামি নিতাম শুধু একজনের কাছ থেকে। তিনি হলেন আমাদের খালাতো ভাই মোহাম্মদ আলী। আমরা তাকে আপন ভাই হিসেবেই জানতাম। ঈদের দিন ঈদগাহ থেকে ফিরে আসার পর আমরা পাঁচ বোন মোহাম্মদ আলী ভাইয়ের জন্য অপেক্ষায় থাকতাম। কখন তিনি আসবেন আর আমাদেরকে সালামি দিবেন। তিনি না আসা পর্যন্ত আমাদের কোন কিছুই ভাল লাগতো না; এমনকি বাসায় আম্মার রান্না করা বিশেষ খাবারগুলোও খেতে ইচ্ছে হতো না। এটা অবশ্য মোহাম্মদ আলী ভাইও জানতেন। সে কারণে নামাজ শেষ হলে তিনিও দেরি করতেন না। দ্রুতই আমাদের বাড়িতে ছুটে আসতেন।

 

আমাদের সময়ে ঈদের দিন সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখার একটা প্রবণতা ছিল। কারণ তখন বিনোদন বিশেষত ঈদের দিন আমোদিত হওয়ার জন্য সিনেমার বিকল্প কিছু ছিল না। সেজন্য অনেকেই সিনেমা হলে হুমড়ি খেয়ে পড়তো। ছেলেদের মধ্যেই এই প্রবণতা বেশি ছিল। তবে মেয়েদেরও কেউ কেউ যেত। তখন ঈদ উপলক্ষ্যে হলগুলোতে একাধিক সিনেমা মুক্তি দেওয়া হতো। কিন্তু একদিনে সবগুলো সিনেমা তো আর দেখা সম্ভব নয়, তাই রেডিওতো বিজ্ঞাপন শুনে বাছাই করতে হতো। বন্ধুদের কেউ কেউ ঈদের দিন সিনেমা হলে গেলেও আমাদের তেমন আগ্রহ ছিল না। কারণ আমাদের বাসায় তখন ভিসিপি (ভিডিও ক্যাসেট প্লেয়ার) ছিল। তাতেই আমরা পছন্দের সিনেমাগুলো দেখতাম।

 

আকাশে সরু চাঁদ ওঠার পর টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে এখন কবি নজরুলের বিখ্যাত সেই গান ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলা খুশির ঈদ.........’ প্রচার করা হয়। গানটি আমার খুবই পছন্দের। সত্যি কথা বলতে কী- ওই গানটি না শোনা পর্যন্ত মনের ভেতরে ঈদের আমেজ তৈরি হয় না। এজন্য ইফতারের পর পরই টেলিভিশন অন করে রাখি...।