বঙ্গবন্ধুকন্যা স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে অন্ধকার থেকে আলোর পথে বাংলাদেশ!
মুনসুর রহমান তানসেন
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন জননেত্রী শেখ হাসিনার ৪২তম স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস আজ। দীর্ঘ ছয় বছর নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফেরেন বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস বাঙ্গালি জাতির জন্য একটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ দিন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের প্রায় সকল সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে পদদলিত করা হয়। যখন বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা করা হয়, তখন শেখ হাসিনা ও তার ছোটবোন শেখ রেহেনাসহ দুই শিশু সন্তান স্বামীর কর্মস্থল পশ্চিম জার্মানীতে অবস্থানের ফলে তারা প্রাণে বেঁচে যান। বঙ্গবন্ধুকে স্বপবিরারে হত্যার পর স্বাধীন বাংলাদেশে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার।
৩০ লাখ শহীদ ও ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে কেনা এই স্বাধীন বাংলাদেশের আকাশ-বাতাস ছেয়ে যায় কালো মেঘে। দেশ চলতে থাকে পরাজিত শক্তি ও যুদ্ধাপরাধীর ইশরায়। পাকবাহিনীর সাথে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন এই বাংলাদেশ পরিচালিত হয় পাকিস্থানী ভাবধারায়। ওই সময় বন্দুকের নলের মুখে কেউ বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলতে পারেনি। যারা বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলেছে তাদেরকে দিতে হয়েছে চরম মুল্য।
বিভিন্ন পত্রিকায় পাওয়া তথ্যমতে বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার পর ভারত সরকারের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন শেখ হাসিনার স্বামী পরমাণু বিজ্ঞানী এম, এ ওয়াজেদ মিয়া। ২৪ আগস্ট সকালে ভারতীয় দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা তাদেরকে ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমান বন্দরে নিয়ে যান। ২৫ আগস্ট সকালে এয়ার ইন্ডিয়ার একটি ফ্লাইটে দিল্লি পৌছান শেখ হাসিনা, শেখ রেহেনা, ড. ওয়াজেদ মিয়া ও তাদের দুই সন্তান।
বিমানবন্দর থেকে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় দিল্লির ডিফেন্স কলোনির একটি বাসায়। সেখান থেকে কারো সঙ্গে যোগাযোগ ও পরিচয় না দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিলো তাদের। সেই সময় ভারতীয় পত্রিকায় বাংলাদেশের তেমন খবরও ছাপা হচ্ছিল না। তাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অন্ধকারে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা। ভারতে পৌছানোর প্রায় দুই সপ্তাহ পরে ড. ওয়াজেদ মিয়া ও শেখ হাসিনা ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বাসায় যান। সেখানেই শেখ হাসিনা ১৫ আগস্টের পুরো ঘটনা জানতে পারেন।
১৯৭৯ ও ১৯৮০ সালে আওয়ামীলীগের কয়েকজন নেতা বিভিন্ন সময়ে দিল্লিতে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার খোঁজখবর নিতে। এখানে আওয়ামীলীগের নেতা সেখানে দেখা সাক্ষাত করার মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনাকে আওয়ামীলীগের নেতৃত্ব নিতে রাজি করানো হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৮১ সালের ১৪, ১৫ ও ১৬ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত আওয়ামীলীগের জাতীয় সম্মেলনে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাকে আওয়ামীলীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়।
এর এক সপ্তাহ পরে ২৪ ফেব্রুয়ায়ি আব্দুল মালেক উকিল, ড. কামাল হোসেন, জিল্লুর রহমান, আব্দুল মান্নান,, আব্দুস সামাদ, এম কোরবান আলী, বেগম জোহরা তাজউদ্দিন গোলাম আকবর চৌধুরী, সাজেদা চৌধুরী, আমির হোসেন আমু, আইভি রহমান, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ ঢাকা থেকে দিল্লি পৌছান। সেখানে শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ২৮ ফেব্রয়ারি পর্যন্ত কয়েকটি বৈঠক করেন তারা। দেশের গণতন্ত্র আর প্রগতিশীল রাজনীতি ফেরাতে রাতে দুই শিশু সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় এবং সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে ছোট বোন শেখ রেহেনার কাছে রেখে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশে ফেরেন শেখ হাসিনা।
১৯৮১ সালের ১৭ মে সেইদিন বৈরী আবহাওয়া ছিলো। কালবৈশাখী ঝড়ের গতিবেগ ছিলো ঘন্টায় ৬৫ মাইল। প্রচন্ড ঝড়বৃষ্টি আর দুর্যোগও সেদিন গতিরোধ করতে পারেনি গণতন্ত্রকামী লাখ লাখ মানুষের। মুষলধারার বৃষ্টি-বাদল উপেক্ষা করে তারা বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছিলেন প্রিয় নেত্রী আমাদের বঙ্গকন্যা কখন আসবেন সেই প্রতিক্ষায়।
অবশেষে বিকেল ৪ টায় কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে জনসমুদ্রের জোয়ারে এসে পৌঁছান বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনা। তখন জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু ধ্বনিতেপ্রকম্পিত হয় বাংলার আকাশ-বাতাস। লাখো জনতার কন্ঠে ধ্বনি উঠে পিতৃহত্যার বদলা নিতে/ লক্ষ ভাই বেঁচে আছে, শেখ হাসিনার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই। দেশের মাটিতে পা দিয়ে লাখো জনতার সংবর্ধনায় আবেগ-আপ্লুত হয়ে শেখ হাসিনা বলেছিলেন সব হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে এসেছি।
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে, তার আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির পিতা হত্যার প্রতিশোধ গ্রহনে আমি আমার জীবন উৎসর্গ করতে চাই। আমার হারাবার আর কিছু নেই, পিতা-মাতা, ভাই রাসেলসহ সবাইকে হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি। আমি আপনাদের মাঝেই তাদেরকে ফিরে পেতে চাই। আমি আওয়ামীলীগের নেত্রী হওয়ার জন্য আসিনি। আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী একজন কর্মী হিসেবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই।
সেইদিন তিনি আরও বলেছিনে জীবনের ঝুঁকি নিতেই হয়, মৃত্যুকে ভয় করলে জীবন মহত্ত্ব থেকে বঞ্চিত হয়। তিনি দৃঢ় কন্ঠে বলেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও স্বপ্ন বাস্তবায়ন. বঙ্গবন্ধুর ও জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচার, স্বৈরতন্ত্রের চির অবসান ঘটিয়ে জনগনের গণতান্ত্রিকঅধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার করাই হবে আমাদের মূল লক্ষ।
শেখ হাসিনার সেইদিনের দুঃসাহসি সিদ্ধান্তের ফলে নানা ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে আওয়ামীলীগ এখন সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী রাজনৈতিক সংগঠন। শেখ হাসিনার সফল নেতৃত্বের ফলে নানমুখী ষড়যন্ত্রের পরেও ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত এবং ২০০৯ সাল থেকে টানা তিন মেয়াদে এখন পর্যন্ত আওয়ামীলীগ রাস্ট্রীয় ক্ষমতায়। যারফলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে আন্তরিকভাবে কাজ করছেন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার।
দেশি-বিদেশী ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচারের রায় কার্যকর করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনীদেরও দেশে ফিরে এনে বিচারের রায় কার্যকরের চেষ্টা চলছে। যারা মনে করেছিলো এই দেশে কোনদিনই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে পারবেনা। দেশি-বিদেশী নানা বাঁধা মোকাবেলা করে বেশ কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীর বিচারের রায় ইতিমধ্যে কার্যকর হয়েছে। বর্তমান যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য চলমান রয়েছে।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে আইন করে এই দেশে খুনীদের বিচারের পথ রুদ্ধ করা হয়েছিলো। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সেই কালো আইন বাতিল করে সকল অপরাধীর বিচারের পথ সুগম করা হয়েছে। দেশ বিরোধী কর্মককান্ড ও সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ দমনে অনেকটা সফল হয়েছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ সরকার। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর কালো মেঘে ঢাকা বাংলাদেশ এখন অন্ধকার থেকে আলোর পথে।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের অভূতপূর্ণ উন্নয়নের পাশাপাশি বড় বড় মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন ও চলমান রয়েছে। আর্থিকভাবে দেশের প্রতিটি মানুষ অগ্রসর হয়েছে। শেখ হাসিনার বলিষ্ট নেতৃত্বে বর্তমান সরকারের সুফল পাচ্ছে দেশের প্রতিটি পরিবার। যারা ভূমিহীন ও গৃহহীন ছিলেন তাদেরকে ভুমিসহ বাড়ি নির্মাণ করে দিয়েছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার। দেশে দরিদ্রের হার কমেছে এবং মানুষের আয় বেড়েছে অনেক বেশী।
শিক্ষা, স্বাস্থ, কৃষি, শিল্প, বিদ্যুৎ দেশের সর্বক্ষেত্রে অভূতপূর্ণ উন্নয়ন হয়েছে। নিম্ন আয়ের দেশ থেকে বাংলাদেশ এখন উন্নত দেশের কাতারে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট্রে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশ যেভাবে অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছিলো সেই অন্ধকার কাটিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন আলোর পথে।