আমাদের মা জননী-২৮
রণাঙ্গনে আয়েশা রা:
জুবাইর হাসান মোহাম্মদ জুলফিকার আলী
[গতকালের পর থেকে পড়তে হবে]
হযরত আয়েশা (রা:) এর জীবন ও কর্ম বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, মুসলিম নারীর কর্তব্য ও অধিকারের সীমারেখা ততটা সংকীর্ণ নয়, যতটা সাধারণভাবে মনে করা হয়। ৩৫ হিজরিতে হযতর ওসমান রা:-এর রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের পর ইসলামের যখন চরম ক্রান্তিকাল চলছিলো তখন হযরত আয়েশা রা: নিশ্চুপ থাকেন নি। এমনকি ৩৬ হিজরিতে সংঘটিত উষ্ট্রী যুদ্ধের রণাঙ্গনেও ছুটে গেছেন। তিনি তো উম্মুল মুমিনীন অর্থাৎ আমাদের মা-জননী। আর তাই সন্তানদের চরম দুর্ভোগ ও দুরবস্থা দেখে মমতাময়ী মায়ের মনে বেদনার ঝড় উঠেছিলো। মাতা হিসাবে তিনি মনে করেছিলেন একমাত্র তাঁর হস্তক্ষেপেই মুসলিম জাহানের আত্মঘাতী কলহ থাতমে পারে। ৩৫-৩৬ হিজরির সেই সময়কালে যখন গোলোযোগ-বিশৃঙ্খলা সর্বভুক হয়ে দেশ ও জাতিকে গ্রাস করে ফেরার উপক্রম হলো, তখন তিনি মনে করলেন যে, মুসলমানদের মধ্যে তিনি ছাড়া আর কেউ আগুন নেভাতে পারে না।
৩৫ হিজরিতে হযরত ওসমান রা:-এর হত্যাকান্ডের সময় হযরত আয়েশা রা: মক্কায় হজ্জব্রত পালন করছিলেন। সেখানেই তিনি এ খবর লাভ করেন। মনে রাখতে হবে, তখনকার তথ্য প্রাপ্তির সহজলভ্যতা এখনকার মতো ছিলো না। সংবাদ প্রাপ্তি ও তার সঠিকতা যাচাই করা ভীষণ দু:সাধ্য ছিলো। যাহোক, তৃতীয় খলিফার হযরত ওসমান রা:-এর শাহাদত বরণের পর মুসলমান সমাজে যে অস্থিরতা দেখা দেয় তা সমাধানের জন্যে হযরত আয়েশা রা: সচেষ্ট হোন। তিনি মক্কা থেকে ইরাকের বসরা অভিমুখে হাজার হাজার জনগণকে সাথে নিয়ে শান্তিকামী কাফেলার নেতৃত্ব দেন। তাঁর এই শান্তিকামী কাফেলার প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিলো নেতৃত্বের সংশোধন ও জনগণের মাঝে শান্তি স্থাপন। যুদ্ধ করবার কোনো অভিপ্রায় তাঁর ছিলো না। তাঁর এই শান্তিকামী কাফেলা একসময় বসরায় মিলিত হলো এবং তিনি এক উত্তাল জনসমুদ্রে আবেগময়ী বক্তৃতা করলেন। এক সময় তিনি বসরা বিজয় করলেন। অতঃপর সমঝোতা-চুক্তির সকল প্রক্রিয়া যখন সম্পন্ন, রাত পোহালেই সোনালি সকালে তা স্বাক্ষরিত হবে, ঠিক সেই মুহূর্তে হযরত ওসমান রা: কে হত্যার নেপথ্যের শক্তি সাবায়ীগণ উস্কানিমূলক হামলা চালিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ বাধিয়ে দেয়। সাবেয়ীগণের এই কাজটি তৃতীয় পক্ষের কারসাজি হিসাবে গণ্য করা হয়। এই সাবায়ীগণের নেতা ছিলো আবদুল্লাহ ইবনে সাবা! সে ছলনা করতেই ইহুদি ধর্ম থেকে বাহ্যিক ইসলামে প্রবেশ করেছিলো। তাঁর নেতৃত্বেই সাবায়ী গোষ্ঠী নানান প্রোপাগান্ডা চালিয়ে ইসলামী সাম্রাজ্যের শাসক ও জনগণকে বিভ্রান্ত করতো। এরা সেই গোষ্ঠী যাদের চিরাচরিত চাল হলো, যখন শত্রুতা করে পারবে না, তখন অস্ত্র ফেলে দেবে; মুহূর্তেই পরিণত হয়ে যাবে পরম মিত্রে। ধীরে ধীরে মেতে উঠবে গোপন ষড়যন্ত্রে। “বল না হলে ছল”-এই তাদের কৌশল। যাহোক, হযরত আয়েশা রা: যুদ্ধের ময়দানে উটের পিঠের হাওদায় (পালকিতে) বসে ছিলেন। আর তাঁকে ঘিরে হাজার হাজার জানবাজ যোদ্ধা লড়াই করছিলেন। এজন্যেই এটাকে জঙ্গে জামাল বা উষ্ট্রী যুদ্ধ বলা হয়। ৩৬ হিজরিতে সংঘটিত এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার প্রকৃত উদ্দেশ্য ক্ষমতা লাভ করা নয়; বরং হযরত আয়েশা (রা:) এর দাবি ছিলো হযরত ওসমান (রা:) এর হত্যাকান্ডে জড়িত সাবায়ীদের শাস্তি প্রদান করা এবং সবার মাঝে সংশোধন ঘটিয়ে জনগণের মাঝে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা।
ইতিহাসের পাতায় হযরত আয়েশা রা:-এর যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত হওয়া এটাই প্রথম নয়। এর আগে রাসূল সা: এর যুগে ৩য় হিজরিতে সংঘটিত উহুদ যুদ্ধে মুসলিম সৈন্যগণ যখন পর্যুদস্ত, বীর লড়াকুদের পদযুগল যখন টলমল, এমন ঝুঁকির মুখেও হযরত আয়েশা রা: দৌড়ে দৌড়ে আহত সৈনিকদের পানি পান করাচ্ছিলেন।১ ৫ম হিজরিতে সংঘটিত খন্দক বা পরিখার যুদ্ধে মুসলমানগণ যখন অবুরুদ্ধ, তখনো তিনি দুর্গ থেকে বের হয়ে যুদ্ধের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছিলেন।২
[তথ্য সূত্র: ১. সহীহ বুখারি: গাযওয়ায়ে উহুদ; উদ্ধৃতঃ সীরাতে আয়েশা, পৃষ্ঠা ১৮৫। ২. মুসনাদে আহমদ, ষষ্ঠ খন্ড, পৃষ্ঠা-১৪১; উদ্ধৃতঃ সীরাতে আয়েশা রা:, পৃষ্ঠা ১৮৫] [পরবর্তী অংশ আগামীকাল]