অভিমান মানেই আত্মহনন নয়, অভিমান হোক সেকেলে
অসীম কুমার কৌশিক
মানুষ বড্ড অভিমানী প্রাণী। অভিমানে মানুষ কতকিছুই না করে। কেউ ডায়েরির পাতা লিখে ভরিয়ে ফেলে, কেউবা বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে থাকে। আবার কেউ অভিমান করে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থাকে। অভিমান এ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত। অভিমান যেন আত্মহনন না হয়। তবে সেটা আর অভিমান হয় না।
সেকালের অভিমানগুলো কতই না মধুর ছিলো। কেউ কেউ তো মা-বাবার উপর অভিমান করে না খেয়ে মুখ গুমড়ে বসে থাকতো। এদিকে মা-বাবাও সামনে খাবারের থালা নিয়ে বেশ আদরের সুরে বলতো, 'কতক্ষণ না খেয়ে থাকতে পারো দেখি।' একসময় মা-বাবার অপার স্নেহের কাছে হেরে গিয়ে অভিমান দূরে পালিয়ে যেত। তখন সন্তানের মাথায় হাত বুলিয়ে ভুলগুলো ধরিয়ে দিতেন পিতামাতা।
প্রিয় মানুষটার উপর অভিমান করে ডায়েরির পাতা লিখে ভরিয়ে ফেলত কেউ। অভিমান তখনও ডায়েরির পাতা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ রয়ে যেত। এদিকে অভিমানিনীর অভিমান ভাঙাতেও ভুলে যেত না প্রিয় মানুষ।
কিন্তু ইদানীংকালে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে অভিমানের মাত্রা এত বেড়ে গিয়েছে যে তারা আত্মহননের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। অভিমান এখন আর ডায়েরীর পাতা বা কেউ এসে মান ভাঙাবে এমন জায়গায় সীমাবদ্ধ নেই। সভ্যতা ও প্রযুক্তির উন্নতির এই যুগে প্রজন্মের কাছে অভিমানের সংজ্ঞা বদলে দিয়েছে যেন। এমন অনেক ঘটনায় উদ্বগের জন্ম দিয়েছে।
সম্প্রতি দেখা যায়, বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার পিরব ইউনিয়নের চাঁপাচিল গ্রামে ধুমপান করতে নিষেধ করায় পরিবারের উপর অভিমান করে আত্মহত্যা করেছে এক কিশোর। এছাড়াও গত বছরের ডিসেম্বরে শেরপুর উপজেলায় নবম শ্রেণির ফাইনলা পরীক্ষায় রেজাল্ট খারাপ হলে বকাবকি করায় পরিবারের উপর অভিমান করে আত্মহত্যা করে এক স্কুলছাত্রী। এর দুইমাস আগে একই উপজেলায় মায়ের উপর অভিমান করে আত্মহননের পথ বেছে নেয় এক যুবক।
এদিকে, বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘আচঁল ফান্ডেশন' তাদের এক জরিপে জানিয়েছে, ২০২৩ সালে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ৫১৩ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন৷ তবে ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিলো ৫৩২ জন।
আঁচল ফাউন্ডেশনের সভাপতি তানসেন রোজ ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, '২০২২ সালের সঙ্গে তুলনা করলে ২০২৩ সালে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা সামান্য কম৷ কিন্তু এটা আসলে কমার কেনো প্রবণতা নয়৷ সামনের বছর দেখা যাবে আবার বেড়ে গেছে৷ আত্মহত্যার কারণ দূর করার কেনো সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ আমরা দেখছি না৷'
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ আত্মহত্যার কারণ হিসাবে দায়ী করেছেন, সামাজিক অস্থিরতা, বেকারত্ব, অসহিষ্ণুতার মাত্রা বেড়ে যাওয়া, পরমত সহিষ্ণুতার অভাব, মানুষের আত্মকেন্দ্রিকতা, মাদকাসক্তি এবং মানুষের যন্ত্র নির্ভরতাকে।
আঁচল ফাউন্ডেশন বলছে, ২০২৩ সালে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার পেছনে বড় কারণ অভিমান। মোট শিক্ষার্থীর ১৬৫ জন (৩২.২%) অভিমান করে, ১৪.৮% প্রেমঘটিত কারণে, ৯.৯% মানসিক সমস্যাজনিত কারণে, ৬.২% পারিবারিক কলহে, ১.৪% পারিবারিক নির্যাতনে, ৪.৫% পড়ালেখার চাপে, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে ৩.৫%, ১.৮% কাঙ্ক্ষিত ফলাফল না পেয়ে, ২.৫% যৌন হয়রানি ও ০.৮% অপমান বোধ করে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।
মানুষ কেন অভিমান করে?
অভিমান খুব আপন জনের উপর হয় কিন্তু রাগ সবার উপর হতে পারে। অভিমান কারও প্রতি প্রত্যাশা থেকে হয়, রাগ একটি আবেগজনীত প্রতিক্রিয়া। রাগ একটা সময় পর কমে যেতে পারে, যেখানে অভিমান সারাজীবন থাকতে পারে। সাধারণভাবে রাগ আর অভিমান ভিন্ন দুটি মানসিক অনুভুতি। এক কথায় রাগের সাথে হিংসাত্মক বা নেতিবাচক মনোভাব জড়িত থাকে। রাগ হলে মানুষ নেতিবাচক কাজে প্রলুব্ধ হয় স্বাভাবিকভাবে। অন্যদের ওপর রেগে আমরা মেজাজ হারাতে পারি। আবার যেকোনো বিরক্তিতেও আমরা রেগে যেতে পারি।
আর অন্য দিকে, অভিমান রাগের চেয়ে বেশি শক্তিশালী। তবে অভিমানের সঙ্গে বিরক্তির সম্পর্ক কম। অভিমানের সঙ্গে অধিকার বলে একটি ব্যাপার থাকে। যার উপর অধিকার আছে তার সাথেই শুধু অভিমান করা যায়। সবার ওপর কি অভিমান করা যায়? কিন্তু সবার ওপর রাগ করা যায়। শতাংশ ভাগে মাত্র ১০শতাংশ মানুষের ওপর আমরা অভিমান দেখাই, আর ৯০ ভাগের ওপর রাগ প্রকাশ করি।
অভিমান যখন আত্মহননঃ
বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপট অনুযায়ী দেখা যায় আত্মহননের সবচেয়ে বড় একটি কারণ হলো অভিমান। সেকালের অভিমান থেকে একালের অভিমানের যেন বিশাল ফারাক। তবে কি প্রজন্মের অবক্ষয় বাড়ছে? নিজের জীবনের প্রতি ভালোবাসা কমে যাচ্ছে? হ্যাঁ, এখন মানুষ প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে পড়েছে অনেক বেশি। মানুষ মানুষের সাথে কথা বলার জন্য এখন বিভিন্ন সামজিক মাধ্যমের উপর ঝুঁকে পড়েছে বেশি। সরাসরি একজন মানুষ অপর মানূষের সাথে কতক্ষণ কথা বলছে? তার চেয়ে বেশি কথা বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এতে করে অভিমান যেমন হারাচ্ছে তার নিজস্বতা, মানুষ হারাচ্ছে নিজের জীবনের প্রতি ভালোবাসা। একজন মানুষ তার আত্মীয়-স্বজন, পরিবার বা তার বন্ধুমহলে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা কিন্তু অজানায় থেকে যাচ্ছে। আপনি সারাদিনে আপনার পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধবের সাথে সরাসরি চোখের দিকে তাকিয়ে কতক্ষণ কথা বলছেন? খুব কম সময়। এর চেয়ে বেশি আপনি তাদের সাথে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যুক্ত থাকেন বেশি।
কোনো একটা বিষয়ে আপনি অভিমান করেছেন। হতে পারে পরিবারের উপর বা প্রিয় মানুষের উপর কিংবা নিজের প্রতি হতাশা। অভিমান করে একাকীত্বে ভুগছেন। আপনার আচরণের পরিবর্তন আপনার পরিবার বা বন্ধু মহল বুঝতে পারছে না। কেননা আপনি অনেক আগেই সরাসরি সকলের সাথে যোগাযোগ কমিয়ে দিয়েছে। এতে করে আপনার অভিমান গুরুত্ব পাচ্ছে না, নিজের জীবনের উপর ক্ষোভ হচ্ছে, হারিয়ে ফেলছেন নিজেকে।
এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। পরিবার, আত্মীয় স্বজন সকলের সাথে সরাসরি কথা বলতে শিখতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সময় কম দিয়ে সরাসরি যোগাযোগের সময়টা বেশি হওয়া জরুরি। নইলে অভিমান এই প্রজন্মকে ভয়াবহতার দিকে নিয়ে গিয়ে আত্মহননের পথে নিয়ে যাচ্ছে। প্রযুক্তি উন্নত হচ্ছে, সভ্যতার উন্নয়ন হচ্ছে, হবেই। মানুষ হিসেবে এসবের সঠিক ব্যবহার করতে হবে। মনে রাখতে হবে একজন মানুষ প্রযুক্তি, অট্টালিকা ছাড়া বাঁচতে পারবে। কিন্তু মানুষ মরে মানুষের অভাবে। তাই অভিমান না হয় একটু সেকেলেই হোক।